চতুর্থ খণ্ড — গুরুভাব (উত্তরার্ধ)

নিবেদন


গুরুভাবের উত্তরার্ধ প্রকাশিত হইল। শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনের মধ্যভাগের পরিচয়মাত্র গ্রন্থে প্রাপ্ত হইয়া পাঠক হয়তো বলিবেন, এ বিপরীত প্রথার অবলম্বন কেন? ঠাকুরের জন্মাবধি সাধনকাল পর্যন্ত সময়ের জীবনেতিহাস পূর্বে লিপিবদ্ধ না করিয়া তাঁহার সিদ্ধাবস্থার কথা অগ্রে বলা হইল কেন? তদুত্তরে আমাদিগকে বলিতে হয় যে —

প্রথম — পূর্ব হইতে মতলব আঁটিয়া আমরা ঐ লোকোত্তর পুরুষের জীবনী লিখিতে বসি নাই। তাঁহার মহদুদার জীবনেতিহাস আমাদের ন্যায় ক্ষুদ্র ব্যক্তির দ্বারা যথাযথ লিপিবদ্ধ হওয়া যে সম্ভবপর, এ উচ্চাশাও কখনো হৃদয়ে পোষণ করিতে সাহসী হই নাই। ঘটনাচক্রে পড়িয়া শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনের দুই-চারিটি কথামাত্র 'উদ্বোধনে'র পাঠকবর্গকে জানাইবার অভিপ্রায়েই আমরা এ কার্যে হস্তক্ষেপ করিয়াছিলাম। উহাতে এতদূর যে আমাদিগকে অগ্রসর হইতে হইবে সে কথা তখন বুঝিতে পারি নাই। অতএব ঐরূপ স্থলে পরের কথা যে পূর্বে বলা হইবে ইহাতে আর বিচিত্রতা কি?

দ্বিতীয়তঃ — শ্রীরামকৃষ্ণ-জীবনের অলৌকিক ঘটনাবলী এবং অদৃষ্টপূর্ব সাধনের কথা লিপিবদ্ধ করিতে আমাদের পূর্বে অনেকেই সচেষ্ট হইয়াছিলেন। স্থলে স্থলে ভ্রম-প্রমাদ পরিলক্ষিত হইলেও ঠাকুরের জীবনের প্রায় সকল ঘটনাই ঐরূপে মোটামুটিভাবে সাধারণের নয়নগোচর হইয়াছিল। তজ্জন্য পুনরায় ঐসকল কথা লিপিবদ্ধ করিতে যাইয়া বৃথা শক্তিক্ষয় না করিয়া এ পর্যন্ত কেহই যে কার্যে হস্তক্ষেপ করেন নাই তদ্বিষয়ে অর্থাৎ ঠাকুরের অলৌকিক ভাবসকল পাঠককে যথাযথ বুঝাইতে যত্ন করাই আমরা যুক্তিযুক্ত বিবেচনা করিয়াছিলাম। আবার ঠাকুরের ভাবমুখে অবস্থান এবং তাঁহাতে গুরুভাবের স্বাভাবিক বিকাশপ্রাপ্তি, এই বিষয়টি প্রথমে না বুঝিতে পারিলে তাঁহার অদ্ভুত চরিত্র, অদৃষ্টপূর্ব মনোভাব এবং অসাধারণ কার্যকলাপের কিছুই বুঝিতে পারা যাইবে না বলিয়াই আমরা ঐ বিষয় পাঠককে সর্বাগ্রে বুঝাইতে প্রয়াস পাইয়াছিলাম।

কেহ কেহ হয়তো বলিবেন, কিন্তু গ্রন্থমধ্যে স্থলে স্থলে ঠাকুরের বিশেষ বিশেষ কার্য ও মনোভাবের কথা বুঝাইতে যাইয়া তোমরা নিজে ঐসকল যেভাবে বুঝিয়াছ তাহাই পাঠককে বলিতে চেষ্টা করিয়াছ। উহাতে তোমাদের বুদ্ধি ও বিবেচনাকেই ঠাকুরের দুরবগাহ চরিত্র ও মনোভাবের পরিমাপক করা হইয়াছে। ঐরূপে তোমাদের বুদ্ধি ও বিবেচনা যে ঠাকুরকেও অতিক্রম করিতে সমর্থ এ কথা স্পষ্টতঃ না হউক পরোক্ষভাবে স্বীকার করিয়া তোমরা কি তাঁহাকে সাধারণ নয়নে ছোট কর নাই? ঐরূপ না করিয়া যথার্থ ঘটনার কেবলমাত্র যথাযথ উল্লেখ করিয়া ক্ষান্ত থাকিলেই তো হইত। উহাতে ঠাকুরকেও ছোট করা হইত না এবং যাহার যেরূপ বুদ্ধি সে সেইভাবেই ঐসকলের অর্থ বুঝিয়া লইতে পারিত।

কথাগুলি আপাতমনোহর হইলেও অল্প চিন্তার ফলেই উহাদের অন্তঃসারশূন্যতা প্রতীয়মান হইবে। কারণ, বিষয়বিশেষ ধরিতে ও বুঝিতে মানব চিরকালই তাহার ইন্দ্রিয়, মন ও বুদ্ধির সহায়তা গ্রহণ করিয়া আসিয়াছে এবং পরেও তদ্রূপ করিতে থাকিবে। ঐরূপ করা ভিন্ন তাহার আর গত্যন্তর নাই। উহাতে এ কথা কিন্তু কখনই প্রতিপন্ন হয় না যে, গ্রাহ্য বিষয়াপেক্ষা তাহার মনবুদ্ধ্যাদি বড়। দেশ, কাল, বিশ্ব, আত্মা, ঈশ্বর প্রভৃতি সকল অনন্ত পদার্থকেই মানব, মন-বুদ্ধির অতীত জানিয়াও পূর্বোক্তভাবে সর্বদা ধরিতে ও বুঝিতে চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু ঐসকল পদার্থকে তাহার ঐরূপে বুঝিবার চেষ্টাকে আমরা পরিমাণ করাও বলি না অথবা দূষণীয়ও বিবেচনা করি না। পরন্তু ইহাই বুঝিয়া থাকি যে, ঐ চেষ্টার ফলে তাহার নিজ মন-বুদ্ধিই পরিশেষে প্রশস্ততা লাভ করিয়া তাহার কল্যাণসাধন করিবে।

অতএব লোকোত্তর পুরুষদিগের অলৌকিক চেষ্টাদির ঐরূপে অনুধাবন করিলে উহাতে আমাদের নিজ কল্যাণই সাধিত হইয়া থাকে, তাঁহাদিগকে পরিমাণ করা হয় না। মন ও বুদ্ধির সাধনপ্রসূত শুদ্ধতা ও সূক্ষ্মতার তারতম্যানুসারেই লোকে তাঁহাদের দিব্যভাব ও কার্যকলাপ অল্প বা অধিক পরিমাণে বুঝিতে ও বুঝাইতে সক্ষম হইয়া থাকে। শ্রীরামকৃষ্ণ-চরিত্র-সম্বন্ধে আমরা যতদূর বুঝিতে সমর্থ হইয়াছি, সমধিক সাধনসম্পন্ন ব্যক্তি তদপেক্ষা অধিকতরভাবে উহা বুঝিতে সমর্থ হইবেন। অতএব ঐ দেবচরিত্র বুঝিবার জন্য আমরা নিজ নিজ মন-বুদ্ধির প্রয়োগ করিলে উহাতে দূষ্য কিছুই নাই; কেবল ঠাকুরের চরিত্রের সবটা বুঝিয়া ফেলিয়াছি — এ কথা মনে না করিলেই হইবে। ঐ কথাটির দৃঢ় ধারণা হৃদয়ে থাকিলেই ঐসকল বৃথা আশঙ্কার আর কোন সম্ভাবনা থাকিবে না। ইতি —

বিনীত
গ্রন্থকার