পঞ্চম খণ্ড — ঠাকুরের দিব্যভাব ও নরেন্দ্রনাথ
অষ্টম অধ্যায়
প্রথম পাদ — সংসারে ও ঠাকুরের নিকটে নরেন্দ্রনাথের শিক্ষা
১ আপনাতে স্ত্রীভাবের ও নরেন্দ্রে পুরুষভাবের প্রকাশ বলিয়া ঠাকুর নির্দেশ করিতেন — উহার অর্থ
ঠাকুর কখনও কখনও নরেন্দ্রের সহিত নিজ স্বভাবের তুলনায় আলোচনা করিয়া আমাদিগকে বলিতেন, "ইহার (তাঁহার নিজের) ভিতরে যে আছে তাহাতে স্ত্রীলোকের ন্যায় ভাবের ও নরেনের ভিতরে যে আছে তাহাতে পুরুষোচিত ভাবের প্রকাশ রহিয়াছে।" কথাগুলি তিনি ঠিক কোন্ অর্থে প্রয়োগ করিতেন তাহা নির্ণয় করা দুষ্কর। তবে ঈশ্বর বা চরম সত্যের অনুসন্ধানে তাঁহারা উভয়ে যে পথে অগ্রসর হইয়াছিলেন অথবা যে উপায় প্রধানতঃ অবলম্বন করিয়াছিলেন তাহার অনুশীলনে প্রবৃত্ত হইলে পূর্বোক্ত কথার একটা সঙ্গত অর্থ প্রাপ্ত হওয়া যায়। কারণ, দেখা যায়, ঈশ্বরলাভ করিতে হইলে যে-সকল উপায় অবলম্বনীয় বলিয়া অধ্যাত্ম শাস্ত্রসমূহ নির্দেশ করিয়াছে, ঠাকুর ঐসকলের প্রত্যেকটি গুরুমুখে শ্রবণমাত্র উহাতে পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপনপূর্বক অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন — নরেন্দ্রনাথের আচরণ কিন্তু ঐরূপ স্থলে সম্পূর্ণ বিভিন্নাকার ধারণ করিত। নরেন্দ্র ঐরূপ স্থলে শাস্ত্র এবং গুরুবাক্যে ভ্রম-প্রমাদের সম্ভাবনা আছে কি না তদ্বিষয় নির্ণয় করিতে নিজ বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রথমেই নিযুক্ত করিতেন এবং তর্কযুক্তিসহায়ে উহাদিগের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর বিবেচনা করিবার পরে উহাদিগের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইতেন। পূর্বসংস্কারবশে দৃঢ় আস্তিক্যবুদ্ধিসম্পন্ন হইলেও নরেন্দ্রের ভিতর — মানবমাত্রেই নানা কুসংস্কার ও ভ্রমপ্রমাদের বশবর্তী, অতএব কাহারও কোন কথা নির্বিচারে গ্রহণ করিব কেন? — এইরূপ একটা ভাব আজীবন দেখিতে পাওয়া যায়। ফলাফল উহার যাহাই হউক এবং উহার উৎপত্তি যথায় যেরূপেই হউক না কেন, বুদ্ধিবৃত্তিসহায়ে বিশ্বাসভক্তিকে ঐরূপে সংযত রাখিয়া আধ্যাত্মিক রাজ্যে এবং অন্য সকল বিষয়ে অগ্রসর হওয়াই যে বর্তমান কালের মানবসাধারণের নিকটে পুরুষোচিত বলিয়া বিবেচিত হয়, এ কথা বলিতে হইবে না।
২ নরেন্দ্রের পারিপার্শ্বিক অবস্থানুগত শিক্ষা, স্বাধীন চিন্তা, সংশয়, গুরুবাদ অস্বীকার করা
পারিপার্শ্বিক অবস্থাসমূহ মানবজীবনে সর্বত্র সর্বকাল বিশেষ অধিকার বিস্তৃত করিয়া বসে। শুদ্ধ অধিকারবিস্তার কেন? — উহারাই উহাকে গন্তব্যপথে সর্বদা নিয়মিত করিয়া থাকে। অতএব নরেন্দ্রের জীবনে উহাদিগের প্রভাব ও প্রেরণা পরিলক্ষিত হইবে ইহাতে বিচিত্র কিছুই নাই। ঠাকুরের নিকটে যাইবার পূর্বেই নরেন্দ্র নিজ অসাধারণ ধীশক্তিপ্রভাবে ইংরাজী কাব্য, সাহিত্য, ইতিহাস ও ন্যায়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া পাশ্চাত্য ভাবে বিশেষরূপে ভাবিত হইয়াছিলেন। স্বাধীন-চিন্তা-সহায়ে সকল বিষয় অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হওয়া-রূপ পাশ্চাত্যের মূলমন্ত্র ঐ সময়েই তাঁহার মনে মজ্জাগত হইয়া গিয়াছিল। সুতরাং শাস্ত্রবাক্যসকলে তিনি যে ঐ সময়ে বিশেষ সন্দিহান হইবেন ও অনেক স্থলে মিথ্যা বোধ করিবেন এবং অভিজ্ঞ শিক্ষকভাবে ভিন্ন অপর কোন ভাবে মানববিশেষকে গুরু বলিয়া স্বীকার করিতে পরাঙ্মুখ হইবেন, ইহাই স্বাভাবিক।
৩ পিতার জীবন ও সমাজের ঐরূপ শিক্ষায় সহায়তা
নিজ অভিভাবকদিগের জীবনাদর্শ এবং কলিকাতার তৎকালীন সমাজের অবস্থা নরেন্দ্রনাথকে পূর্বোক্ত ভাবপোষণে সহায়তা করিয়াছিল। পিতামহ আজীবন হিন্দুশাস্ত্রে অশেষ আস্থাসম্পন্ন থাকিয়া সন্ন্যাস গ্রহণ করিলেও নরেন্দ্রের পিতা পাশ্চাত্য শিক্ষা ও স্বাধীন চিন্তার ফলে উক্ত বিশ্বাস হারাইয়াছিলেন। পারস্য কবি হাফেজের কবিতা এবং বাইবেল-নিবদ্ধ ঈশার বাণীসমূহ তাঁহার নিকটে আধ্যাত্মিক ভাবের চূড়ান্ত বলিয়া পরিগণিত হইত। সংস্কৃতভাষায় অজ্ঞতাবশতঃ গীতাপ্রমুখ হিন্দুশাস্ত্রসকল অধ্যয়ন করিতে না পারাতেই যে তাঁহাকে আধ্যাত্মিক রসোপভোগের জন্য ঐসকল গ্রন্থের শরণাপন্ন হইতে হইয়াছিল তাহা বলিতে হইবে না। আমরা শুনিয়াছি, নরেন্দ্রকে ধর্মালোচনায় প্রবৃত্ত দেখিয়া তিনি তাহাকে একখানি বাইবেল উপহার দিয়া একদিন বলিয়াছিলেন, 'ধর্মকর্ম যদি কিছু থাকে তাহা কেবলমাত্র ইহারই ভিতরে আছে'। হাফেজের কবিতাবলী এবং বাইবেলের ঐরূপে প্রশংসা করিলেও তাঁহার জীবন যে ঐসকল গ্রন্থোক্ত আধ্যাত্মিক ভাবে নিয়মিত ছিল, তাহা নহে। উহাদিগের সহায়ে ক্ষণিক রসানুভব ভিন্ন ঐরূপ করিবার প্রয়োজনীয়তা তিনি কখনও অনুভব করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। অর্থোপার্জন করিয়া স্বয়ং ভোগসুখে থাকিব এবং যথাসম্ভব দান করিয়া দশজনকে সুখী করিব — ইহাই তাঁহার জীবনের চরম উদ্দেশ্য ছিল। উহা হইতে এবং তাঁহার দৈনন্দিন জীবনের আলোচনায় বুঝা যায়, ঈশ্বর, আত্মা, পরকাল প্রভৃতি বিষয়ে তাঁহার বিশ্বাস কতদূর শিথিল ছিল। বাস্তবিক পাশ্চাত্যের জড়বাদ ও ইহকালসর্বস্বতা তখন নরেন্দ্রের পিতার ন্যায় ব্যক্তিদিগের ভিতর আধ্যাত্মিক বিষয়সকলে দারুণ সংশয় ও অনেক সময়ে নাস্তিকতা আনয়নপূর্বক আমাদিগের প্রাচীন ঋষি ও শাস্ত্রসকলের নিকটে দুর্বলতা ও কুসংস্কার ভিন্ন অন্য কিছু শিক্ষিতব্য নাই ইহাই প্রতিপন্ন করিতেছিল এবং উহার প্রভাবে ধর্মবিশ্বাস ও নৈতিক-মেরুদণ্ড-বিহীন হইয়া তাহারা অন্তরে একরূপ ও বাহিরে অন্যরূপ ভাব পোষণপূর্বক দিন দিন স্বার্থপর ও কপটাচারী হইয়া উঠিয়াছিল। মহামনস্বী রাজা রামমোহন রায়-প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজ ঐ দেশব্যাপী স্রোতের গতি স্বল্পকাল ফিরাইবার চেষ্টা করিয়া পরিণামে পাশ্চাত্য ভাবের প্রবল প্রভাবে অন্তর্বিবাদে দুই দলে বিভক্ত ও ক্ষীণ হইয়া পড়িয়াছিল এবং ঐ দুই দলভুক্ত ব্যক্তিসকলের মধ্যেও পূর্বোক্ত স্রোতে গাত্র ঢালিবার লক্ষণ তখন কিছু কিছু প্রকাশ পাইতেছিল।
৪ পাশ্চাত্য ন্যায়, বিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াও নরেন্দ্রের সত্যলাভ হইল না বলিয়া অশান্তি
১৮৮১ খ্রীষ্টাব্দে এফ.এ. পরীক্ষার পরে শ্রীযুত নরেন্দ্র পাশ্চাত্য বিজ্ঞান ও দর্শনশাস্ত্রের সহিত বিশেষভাবে পরিচিত হইয়াছিলেন। মিল-প্রমুখ পাশ্চাত্য নৈয়ায়িকসকলের মতবাদ তিনি ইতঃপূর্বেই আয়ত্ত করিয়াছিলেন; এখন — ডেকার্টের 'অহংবাদ', হিউম এবং বেনের 'নাস্তিকতা', স্পাইনোজার 'অদ্বৈতচিদ্বস্তুবাদ', ডারউইনের 'অভিব্যক্তিবাদ' ও কোঁতে ও স্পেন্সরের 'অজ্ঞেয়বাদ' এবং আদর্শ সমাজের অভিব্যক্তি প্রভৃতি পাশ্চাত্য দার্শনিক মতবাদসমূহ আয়ত্ত করিয়া সত্যবস্তু নির্ণয় করিবার বিষম উৎসাহ তাঁহার প্রাণে উপস্থিত হইয়াছিল। জার্মান দার্শনিকসকলের প্রশংসাবাদ শ্রবণ করিয়া দর্শনেতিহাসগ্রন্থসকলের সহায়ে তিনি কান্ট, ফিক্টে, হেগেল, শোপেনহাওয়ার প্রভৃতির মতবাদের যথাসম্ভব পরিচয়গ্রহণেও অগ্রসর হইয়াছিলেন। আবার স্নায়ু ও মস্তিষ্কের গঠন ও কার্যপ্রণালীর সহিত পরিচিত হইবার জন্য তিনি বন্ধুবর্গের সহিত মধ্যে মধ্যে মেডিকেল কলেজে যাইয়া শারীরবিজ্ঞান সম্বন্ধীয় বক্তৃতাশ্রবণ ও গ্রন্থপাঠে মনোনিবেশ করিয়াছিলেন। ফলে ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দে বি.এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইবার পূর্বেই তিনি পাশ্চাত্য দর্শনে বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু ঐ অভিজ্ঞতা হইতে নিরপেক্ষ সদ্বস্তু ঈশ্বরের সাক্ষাৎকারলাভের নিশ্চয় উপায় জানিতে পারা এবং শান্তিলাভ করা দূরে থাকুক, মানব-মন-বুদ্ধি-প্রচারের সীমা ও ঐ সীমা অতিক্রম করিয়া অবস্থিত সত্যবস্তুকে প্রকাশ করিবার উহাদের নিতান্ত অসামর্থ্য স্পষ্ট প্রতীয়মান হইয়া তাঁহার প্রাণে অশান্তির স্রোত অধিকতর বেগে প্রবাহিত হইয়াছিল।
৫ নরেন্দ্রের সন্দেহ — প্রাচ্য অথবা পাশ্চাত্য, কোন্ প্রথানুসারে তত্ত্বানুসন্ধানে অগ্রসর হওয়া কর্তব্য
পাশ্চাত্য-দর্শন ও বিজ্ঞানসহায়ে নরেন্দ্র স্পষ্ট হৃদয়ঙ্গম করিয়াছিলেন, ইন্দ্রিয় ও মস্তিষ্কের আক্ষেপ বা উত্তেজনা মানবমনে প্রতি মুহূর্তে নানা বিকার আনয়নপূর্বক তাহাতে সুখদুঃখাদি জ্ঞানের প্রকাশ উপস্থিত করিতেছে। ঐসকল মানসিক বিকারই মানব দেশকালাদি-সহায়ে সাক্ষাৎসম্বন্ধে অনুভব করিতেছে, কিন্তু বহির্জগৎ ও তদন্তর্গত যে-সকল বস্তু পূর্বোক্ত উত্তেজনা ও বিকারসমূহ তাহার ভিতর উপস্থিত করিতেছে, তাহাদিগের যথার্থ স্বরূপ চিরকাল তাহার নিকটে অজ্ঞেয় হইয়া রহিয়াছে। অন্তর্জগৎ বা মানবের নিজ স্বরূপ সম্বন্ধেও ঐ কথা সমভাবে প্রযোজ্য হইয়া রহিয়াছে। সেখানেও দেখা যাইতেছে কোন এক অপূর্ব বস্তু নিজশক্তিসহায়ে মনে অহংজ্ঞান ও নানা ভাবের উদয় করিলেও তাহার স্বরূপ দেশকালের বাহিরে অবস্থান করায় মানব উহাকে ধরিতে বুঝিতে পারিতেছে না। ঐরূপে অন্তরে ও বাহিরে, যেদিকেই মানব-মন চরম সত্যের অনুসন্ধানে ধাবিত হইতেছে সেইদিকেই সে দেশকালের দুর্ভেদ্য প্রাচীরে প্রতিহত হইয়া আপনার অকিঞ্চিৎকরত্ব সর্বথা অনুভব করিতেছে। ঐরূপে, পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন-বুদ্ধিরূপ যে যন্ত্রসহায়ে মানব বিশ্বরহস্য-উদ্ঘাটনে ধাবিত হইয়াছে, তাহার বিশ্বের চরম কারণ প্রকাশ করিবার অসামর্থ্য — ইন্দ্রিয়জ প্রত্যক্ষ, যাহার উপর ভিত্তিস্থাপনপূর্বক সে সকল বিষয়ে অনুমান ও মীমাংসায় ব্যস্ত রহিয়াছে, তাহার ভিতরে নিরন্তর ভ্রমপ্রমাদের বর্তমানতা — শরীর ভিন্ন আত্মার পৃথগস্তিত্ব আছে কি না তদ্বিষয় নিরাকরণে পাশ্চাত্য পণ্ডিতকুলের সকল চেষ্টার বিফলতা, প্রভৃতি নানা বিষয় নরেন্দ্রনাথ জানিতে পারিয়াছিলেন। ঐজন্য আধ্যাত্মিক তত্ত্ব সম্বন্ধে পাশ্চাত্যদর্শনের চরম মীমাংসাসমূহ তাঁহার নিকটে যুক্তিযুক্ত বলিয়া প্রতীত হয় নাই। রূপ-রসাদি-বিষয়ভোগে নিরন্তর আসক্ত মানবসাধারণের প্রত্যক্ষসকলকে সহজ ও স্বাভাবিক স্বীকার করিয়া লইয়া উহার উপর ভিত্তিস্থাপনপূর্বক পাশ্চাত্যের অনুসরণে দর্শনশাস্ত্র গড়িয়া তোলা ভাল, অথবা বুদ্ধাদি চরিত্রবান মহাপুরুষসকলের অসাধারণ প্রত্যক্ষসকল ইতরসাধারণ-মানব-প্রত্যক্ষের বিরোধী হইলেও, সত্য বলিয়া স্বীকারপূর্বক উহাদিগকে ভিত্তিরূপে অবলম্বন করিয়া প্রাচ্যের প্রথানুসারে দার্শনিক তত্ত্বানুসন্ধানে অগ্রসর হওয়া কর্তব্য — ঐরূপ সন্দেহও তাঁহার মনে উদিত হইয়াছিল।
৬ ঈশ্বর বা চরম সত্যলাভের সঙ্কল্প দৃঢ় রাখিয়া নরেন্দ্রের পাশ্চাত্য প্রথার গুণভাগমাত্র গ্রহণ
পাশ্চাত্য-দর্শনোক্ত আধ্যাত্মিক মীমাংসাসকলের অধিকাংশ নরেন্দ্রনাথের অযুক্তিকর বলিয়া মনে হইলেও জড়বিজ্ঞানের আবিষ্কারসমূহের এবং পাশ্চাত্যের বিশ্লেষণ-প্রণালীর তিনি ভূয়সী প্রশংসা করিতেন এবং মনোবিজ্ঞানের ও আধ্যাত্মিক রাজ্যের তত্ত্বসকলের পরীক্ষাস্থলে উহাদিগের সহায়তা সর্বদা গ্রহণ করিতেন। ঠাকুরের জীবনের অসাধারণ প্রত্যক্ষসমূহ তিনি উহাদিগের সহায়ে বিশ্লেষণ করিয়া বুঝিতে এখন হইতে সর্বদা সচেষ্ট থাকিতেন এবং ঐরূপ পরীক্ষায় যে-সকল তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হইত সেইসকলকে সত্য বলিয়া গ্রহণপূর্বক নির্ভয়ে তাহাদিগের অনুষ্ঠান করিতেন। সত্যলাভের জন্য বিষম অস্থিরতা তাঁহার প্রাণ অধিকার করিলেও না বুঝিয়া কোনরূপ অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হওয়া এবং কাহাকেও ভয়ে ভক্তি করা তাঁহার এককালে প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। বিচারবুদ্ধির যথাশক্তি পরিচালনের পরিণাম যদি নাস্তিক্য হয় তাহাও তিনি গ্রহণে স্বীকৃত ছিলেন এবং সংসারে ভোগসুখ তো দূরের কথা, নিজ প্রাণের বিনিময়ে যদি জীবনরহস্যের সমাধান ও সত্যপ্রকাশ উপস্থিত হয় তাহাতেও তিনি পরাঙ্মুখ ছিলেন না। সুতরাং চরম সত্যের অনুসন্ধানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া নির্ভয়ে তিনি এই সময়ে পাশ্চাত্য শিক্ষার অনুসরণে ও উহার গুণভাগ গ্রহণে আপনাকে নিযুক্ত রাখিয়াছিলেন। উহার প্রভাবে তিনি বিশ্বাস-ভক্তির সরল পথ পরিত্যাগ করিয়া সময়ে সময়ে নানা সন্দেহজালে নিপীড়িত ও অভিভূত হইয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার অসাধারণ অধ্যবসায় ও ধীশক্তিই জয়ী হইয়া পরিণামে তাঁহাকে সত্যলাভে কৃতার্থম্মন্য করিয়াছিল। লোকে কিন্তু এই কালে অনেক সময়ে ভাবিয়া বসিত, পাশ্চাত্য গ্রন্থসকলে যে-সকল মত প্রকাশিত হয়, নরেন্দ্র সে-সকলই নির্বিচারে গ্রহণ করিয়া থাকেন। তাঁহার পাশ্চাত্য মতসকলের পক্ষপাতিত্ব এ সময়ে তাঁহার বন্ধুবর্গের ভিতর এত প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল যে, গীতা অধ্যয়ন করিয়া তিনি যেদিন তাঁহাদিগের নিকটে উহার ভূয়সী প্রশংসা করিতে আরম্ভ করিলেন, সেদিন বিস্মিত হইয়া তাঁহারা তাঁহার ঐরূপ আচরণের কথা ঠাকুরের কর্ণগোচর করিয়াছিলেন। ঠাকুরও তাহাতে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন, "সাহেবদের মধ্যে কেহ গীতা সম্বন্ধে ঐরূপ মত প্রকাশ করিয়াছে বলিয়া সে ঐরূপ করে নাই তো?"
৭ অদ্ভুত দর্শন ও শ্রীগুরুর কৃপায় নরেন্দ্রের আস্তিক্যবুদ্ধি এইকালে রক্ষিত হয়
পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে অন্তরে বিশেষ ভাব-পরিবর্তনের পূর্বেই নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুণ্যদর্শন লাভপূর্বক কতকগুলি অসাধারণ প্রত্যক্ষের অধিকারী হইয়াছিলেন। ঐসকলের কথা আমরা ইতঃপূর্বেই পাঠককে বলিয়াছি। নরেন্দ্রের আস্তিক্যবুদ্ধিকে সুদৃঢ় রাখিতে উহারা এখন বিশেষ সহায়তা করিয়াছিল বলিয়া বুঝিতে পারা যায়। নতুবা পাশ্চাত্যের ভাব ও মতবাদ জগৎ-কারণ ঈশ্বরকে অজ্ঞেয় প্রমাণ করিয়া তাঁহাকে কতদূরে কোথায় লইয়া যাইত তাহা নির্ণয় করা দুষ্কর। স্বাভাবিক পুণ্যসংস্কারবশে তাঁহার আস্তিক্যবুদ্ধির উহাতে এককালে লোপসাধন না হইলেও উহা বিষম বিপর্যস্ত হইত বলিয়াই বোধ হইয়া থাকে। কিন্তু তাহা হইবার নহে। নরেন্দ্রের দেবরক্ষিত জীবন বিশেষ কার্য সম্পন্ন করিতেই সংসারে উপস্থিত হইয়াছিল, অতএব ঐরূপ হইবে কেন? দেবকৃপায় তিনি যাঁহার আশ্রয় লাভ করিয়াছিলেন সেই সদ্গুরুই তাঁহাকে বারংবার বলিয়াছিলেন, "মানবের সকরুণ প্রার্থনা ঈশ্বর সর্বদা শ্রবণ করিয়া থাকেন এবং তোমাতে আমাতে যেভাবে বসিয়া কথোপকথন করিতেছি ইহা অপেক্ষাও স্পষ্টতরভাবে তাঁহাকে দেখিতে, তাঁহার বাণী শ্রবণ করিতে ও তাঁহাকে স্পর্শ করিতে পারা যায়, এ কথা আমি শপথ করিয়া বলিতে প্রস্তুত আছি!" — আবার বলিয়াছিলেন, "সাধারণ-প্রসিদ্ধ ঈশ্বরের যাবতীয় রূপ এবং ভাবকে মানব-কল্পনাপ্রসূত বলিয়া যদি না মানিতে পার, অথচ জগতের নিয়ামক ঈশ্বর একজন আছেন এ কথায় বিশ্বাস থাকে তাহা হইলে — 'হে ঈশ্বর, তুমি কেমন তাহা জানি না; তুমি যেমন, তেমনি ভাবে আমাকে দেখা দাও' — এইরূপ কাতর প্রার্থনা করিলেও তিনি উহা শ্রবণপূর্বক কৃপা করিবেন নিশ্চয়!" ঠাকুরের এইসকল কথা নরেন্দ্রনাথকে অশেষ আশ্বাস প্রদানপূর্বক সাধনায় অধিকতর নিবিষ্ট করিয়াছিল, এ কথা বলা বাহুল্য।
পাশ্চাত্য-দার্শনিক হ্যামিলটন তৎকৃত দর্শনগ্রন্থের সমাপ্তিকালে বলিয়াছেন, 'জগতের নিয়ামক ঈশ্বর আছেন এই সত্যের আভাসমাত্র দিয়া মানববুদ্ধি নিরস্ত হয়; ঈশ্বর কিংস্বরূপ এ বিষয় প্রকাশ করিতে তাহার সামর্থ্যে কুলায় না; সুতরাং দর্শনশাস্ত্রের ঐখানেই ইতি — এবং যেখানে দর্শনের ইতি সেখানেই আধ্যাত্মিকতার আরম্ভ।' হ্যামিলটনের ঐ কথা নরেন্দ্রনাথের বিশেষ রুচিকর ছিল এবং কথাপ্রসঙ্গে উহা তিনি সময়ে সময়ে আমাদের নিকটে উল্লেখ করিতেন। যাহা হউক, সাধনায় মনোনিবেশ করিলেও নরেন্দ্র দর্শনাদি গ্রন্থপাঠ ছাড়িয়া দেন নাই। ফলতঃ গ্রন্থপাঠ, ধ্যান ও সঙ্গীতেই তিনি এই সময়ে অনেক কাল অতিবাহিত করিতেন।
৯ নূতন প্রণালী অবলম্বনে সারারাত্র ধ্যান
ধ্যানাভ্যাসের এক নূতন পথ তিনি এখন হইতে অবলম্বন করিয়াছিলেন। আমরা ইতঃপূর্বে বলিয়াছি, সাকার বা নিরাকার যেরূপেই ঈশ্বরকে ভাবি না কেন, মানবীয় ধর্মভূষিত করিয়া তাঁহাকে ভাবা১ ভিন্ন আমাদিগের গত্যন্তর নাই। ঐ কথা হৃদয়ঙ্গম করিবার পূর্বে নরেন্দ্রনাথ ধ্যান করিবার কালে ব্রাহ্মসমাজোক্ত পদ্ধতিতে নিরাকার সগুণ ব্রহ্মের চিন্তাতে মনকে নিযুক্ত রাখিতেন। ঈশ্বরীয় স্বরূপের ঐরূপ ধারণা পর্যন্ত মানবীয় কল্পনাদুষ্ট স্থির করিয়া তিনি এখন ধ্যানের উক্ত অবলম্বনকেও পরিত্যাগ করিয়াছিলেন, এবং 'হে ঈশ্বর, তুমি তোমার সত্যস্বরূপ দর্শনের আমাকে অধিকারী কর' — এই মর্মে প্রার্থনা পুরঃসর মন হইতে সর্বপ্রকার চিন্তা দূরীভূত করিয়া নিবাতনিষ্কম্প দীপশিখার ন্যায় উহাকে নিশ্চল রাখিয়া অবস্থান করিতে অভ্যাস করিতে লাগিলেন। স্বল্পকাল ঐরূপ করিবার ফলে নরেন্দ্রনাথের সংযত চিত্ত উহাতে এতদূর মগ্ন হইয়া যাইত যে, নিজ শরীরের এবং সময়ের জ্ঞান পর্যন্ত তাঁহার সময়ে সময়ে তিরোহিত হইয়া যাইত। বাটীর সকলে সুপ্ত হইবার পরে নিজ কক্ষে ধ্যানে বসিয়া তিনি ঐভাবে সমস্ত রজনী অনেক দিবস অতিবাহিত করিয়াছেন।
১০ ঐরূপ ধ্যানে অদ্ভুত দর্শন — বুদ্ধদেব
ঐরূপে ধ্যানের ফলে একদা এক দিব্যদর্শন নরেন্দ্রনাথের উপস্থিত হইয়াছিল। প্রসঙ্গক্রমে নিম্নলিখিতভাবে তিনি উহা একদিন আমাদিগকে বলিয়াছিলেন:
"অবলম্বনশূন্য করিয়া মনকে স্থির রাখিবার কালে অন্তরে একটা প্রশান্ত আনন্দের ধারা প্রবাহিত হইতে থাকিত। ধ্যানভঙ্গের পরেও উহার প্রভাবে একটা নেশার ন্যায় ঝোঁক অনেক ক্ষণ পর্যন্ত অনুভব করিতাম। তজ্জন্য সহসা আসন ছাড়িয়া উঠিতে প্রবৃত্তি হইত না। ধ্যানাবসানে একদিন ঐভাবে বসিয়া থাকিবার কালে দেখিতে পাইলাম, দিব্য জ্যোতিতে গৃহ পূর্ণ করিয়া এক অপূর্ব সন্ন্যাসিমূর্তি কোথা হইতে সহসা আগমনপূর্বক আমার সম্মুখে কিছু দূরে দণ্ডায়মান হইলেন! তাঁহার অঙ্গে গৈরিক বসন, হস্তে কমণ্ডলু এবং মুখমণ্ডলে এমন স্থির প্রশান্ত ও সর্ববিষয়ে উদাসীনতাপ্রসূত একটা অন্তর্মুখী ভাব যে, উহা আমাকে বিশেষরূপে আকৃষ্ট করিয়া স্তম্ভিত করিয়া রাখিল। যেন কিছু বলিবার অভিপ্রায়ে আমার প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া তিনি ধীর পদক্ষেপে আমার দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। উহাতে ভয়ে সহসা এমন অভিভূত হইয়া পড়িলাম যে, আর স্থির থাকিতে না পারিয়া আসন ত্যাগপূর্বক দ্বার অর্গলমুক্ত করিলাম এবং দ্রুতপদে গৃহের বাহিরে চলিয়া আসিলাম। পরক্ষণেই মনে হইল, এত ভয় কিসের জন্য? সাহসে নির্ভর করিয়া সন্ন্যাসীর কথা শুনিবার জন্য পুনরায় গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলাম, কিন্তু অনেক ক্ষণ অপেক্ষা করিয়াও আর তাঁহাকে দেখিতে পাইলাম না! তখন বিষণ্ণমনে ভাবিতে লাগিলাম, তাঁহার কথা না শুনিয়া পলায়ন করিবার দুর্বুদ্ধি আমার কেন আসিয়া উপস্থিত হইল। সন্ন্যাসী অনেক দেখিয়াছি কিন্তু অমন অপূর্ব মুখের ভাব কাহারও কখনও নয়নগোচর করি নাই। সে মুখখানি চিরকালের নিমিত্ত আমার হৃদয়ে মুদ্রিত হইয়া গিয়াছে। হইতে পারে ভ্রম, কিন্তু অনেক সময়ে মনে হয় বুদ্ধদেবের দর্শনলাভে আমি সেই দিন ধন্য হইয়াছিলাম!"
১ Anthropomorphic idea of God.