পঞ্চম খণ্ড — ঠাকুরের দিব্যভাব ও নরেন্দ্রনাথ
অষ্টম অধ্যায়
দ্বিতীয় পাদ — সংসারে ও ঠাকুরের নিকটে নরেন্দ্রনাথের শিক্ষা
ঐরূপে নির্জনবাস, অধ্যয়ন, তপস্যা ও দক্ষিণেশ্বরে গমনাগমনপূর্বক নরেন্দ্রের সময় অতিবাহিত হইতে লাগিল। ভবিষ্যৎ কল্যাণ চিন্তাপূর্বক তাঁহার পিতা তাঁহাকে এই সময়ে কলিকাতার সুপ্রসিদ্ধ এটর্নি নিমাইচরণ বসুর অধীনে এটর্নির ব্যবসায় শিখিবার জন্য নিযুক্ত করিয়া দিলেন। পুত্রকে সংসারী করিবার আশায় শ্রীযুত বিশ্বনাথ উপযুক্ত পাত্রীর অন্বেষণেও এই সময়ে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। কিন্তু বিবাহ করায় নরেন্দ্রের বিষম আপত্তি থাকায় এবং মনোমত পাত্রীর সন্ধান না পাওয়ায় তাঁহার ঐ আশা সফল হইতে বিলম্ব হইতে লাগিল।
২ অখণ্ড ব্রহ্মচর্য পালনে ঠাকুরের নরেন্দ্রকে উপদেশ
রামতনু বসু লেনস্থ নরেন্দ্রের পাঠগৃহে ঠাকুর কখনও কখনও সহসা আসিয়া উপস্থিত হইতেন এবং সাধনভজন সম্বন্ধে নানাবিধ উপদেশ প্রদান করিতেন। পিতামাতার সকরুণ অনুরোধে পাছে নরেন্দ্র উদ্বাহ-বন্ধনে নিজ জীবন চিরকালের মতো আবদ্ধ ও সঙ্কুচিত করিয়া বসেন এজন্য ঐ সময়ে তিনি তাঁহাকে সতর্ক করিয়া ব্রহ্মচর্য-পালনে সতত উৎসাহিত করিতেন। বলিতেন, "বার বৎসর অখণ্ড ব্রহ্মচর্য-পালনের ফলে মানবের মেধানাড়ি খুলিয়া যায়, তখন তাহার বুদ্ধি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয়সকলে প্রবেশ ও উহাদিগের ধারণা করিতে সমর্থ হয়; ঐরূপ বুদ্ধিসহায়েই ঈশ্বরকে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করিতে পারা যায়; তিনি কেবলমাত্র ঐরূপ শুভবুদ্ধির গোচর।"
৩ নরেন্দ্রের বাটীর সকলের ভয় — সন্ন্যাসীর সহিত মিলিত হইয়া সন্ন্যাসী হইবে
ঠাকুরের সহিত ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের ফলেই নরেন্দ্র বিবাহ করিতে চাহে না — এইরূপ একটা ধারণা বাটীর স্ত্রীলোকদিগের ভিতর এই সময়ে উপস্থিত হইয়াছিল। নরেন্দ্র বলিতেন, "পাঠগৃহে উপস্থিত হইয়া ঠাকুর যখন একদিন পূর্বোক্তভাবে ব্রহ্মচর্য-পালনে আমাকে উপদেশ দিতেছিলেন, তখন আমার মাতামহী আড়াল হইতে সকল কথা শ্রবণপূর্বক পিতামাতার নিকটে বলিয়া দিয়াছিলেন। সন্ন্যাসীর সহিত মিলিত হইয়া পাছে আমি সন্ন্যাসী হইয়া যাই — এই ভয়ে তাঁহারা ঐদিন হইতে আমার বিবাহ দিবার জন্য বিশেষরূপে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু করিলে কি হইবে, ঠাকুরের প্রবল ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাঁহাদিগের সকল চেষ্টা ভাসিয়া গিয়াছিল। সকল বিষয় স্থির হইবার পরেও কয়েক স্থলে সামান্য কথায় উভয় পক্ষের মধ্যে মতদ্বৈধ উপস্থিত হইয়া বিবাহ-সম্বন্ধ সহসা ভাঙিয়া গিয়াছিল!"
৪ ঠাকুরের নিকটে নরেন্দ্রের পূর্বের ন্যায় যাতায়াত
দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে গমনাগমন করাটা বাটীর সকলের রুচিকর না হইলেও নরেন্দ্রনাথকে ঐ বিষয়ে কেহ কোন কথা বলিতে কখনও সাহস করেন নাই। কারণ জনক-জননীর পরম আদরের পুত্র নরেন্দ্র বাল্যকাল হইতে কখনও কাহারও নিষেধ মানিয়া চলিতেন না এবং যৌবনে পদার্পণ করিয়া অবধি আহার-বিহারাদি সকল বিষয়ে অসীম স্বাধীনতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। সুতরাং বালক বা তরলমতি যুবককে আমরা যেভাবে নিষেধ করিয়া থাকি, প্রখরবুদ্ধি নরেন্দ্রকে এখন সেইভাবে কোন বিষয় নিষেধ করিলে ফল বিপরীত হইবার সম্ভাবনা, এ কথা তাঁহাদিগের সকলের জানা ছিল। সেজন্য পূর্বের ন্যায় সমভাবেই নরেন্দ্র দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের সকাশে যাতায়াত করিয়াছিলেন।
৫ দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে যেভাবে দিন কাটিত তদ্বিষয়ে নরেন্দ্রের কথা
ঠাকুরের পুণ্যসঙ্গে শ্রীযুত নরেন্দ্র এই সময়ে দক্ষিণেশ্বরে যেসকল দিন অতিবাহিত করিয়াছিলেন, সেইসকলের মধুময় স্মৃতি তাঁহার অন্তর আজীবন অসীম উল্লাসে পূর্ণ করিয়া রাখিত। তিনি বলিতেন, "ঠাকুরের নিকটে কি আনন্দে দিন কাটিত, তাহা অপরকে বুঝানো দুষ্কর। খেলা, রঙ্গরস প্রভৃতি সামান্য দৈনন্দিন ব্যাপার-সকলের মধ্য দিয়া তিনি কিভাবে নিরন্তর উচ্চশিক্ষা প্রদানপূর্বক আমাদিগের অজ্ঞাতসারে আমাদিগের আধ্যাত্মিক জীবন গঠন করিয়া দিয়াছিলেন, তাহা এখন ভাবিয়া বিস্ময়ের অবধি থাকে না। বালককে শিখাইবার কালে শক্তিশালী মল্ল যেরূপে আপনাকে সংযত রাখিয়া তদনুরূপ শক্তিমত্তা প্রকাশপূর্বক কখনও তাহাকে যেন অশেষ আয়াসে পরাভূত করিয়া এবং কখনও বা তাহার নিকটে স্বয়ং পরাভূত হইয়া তাহার মনে আত্মপ্রত্যয় জন্মাইয়া দেয়, আমাদিগের সহিত ব্যবহারে ঠাকুর এইকালে অনেক সময়ে সেইরূপ ভাব অবলম্বন করিতেন। তিনি বিন্দুর মধ্যে সিন্ধুর বর্তমানতা সর্বদা প্রত্যক্ষ করিতেন। আমাদিগের প্রত্যেকের অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিকতার বীজ ফুল-ফলায়িত হইয়া কালে যে আকার ধারণ করিবে, তাহা তখন হইতে ভাবমুখে প্রত্যক্ষ করিয়া আমাদিগকে প্রশংসা করিতেন, উৎসাহিত করিতেন, এবং বাসনাবিশেষে আবদ্ধ হইয়া পাছে আমরা জীবনের ঐরূপ সফলতা হারাইয়া বসি, তজ্জন্য বিশেষ সতর্কতার সহিত আমাদিগের প্রতি আচরণ লক্ষ্য করিয়া উপদেশপ্রদানে আমাদিগকে সংযত রাখিতেন। কিন্তু তিনি যে ঐরূপে তন্ন তন্ন করিয়া লক্ষ্যপূর্বক আমাদিগকে নিত্য নিয়মিত করিতেছেন, এ কথা আমরা কিছুমাত্র জানিতে পারিতাম না। উহাই ছিল তাঁহার শিক্ষাপ্রদান এবং জীবনগঠন করিয়া দিবার অপূর্ব কৌশল। ধ্যান-ধারণাকালে কিছুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হইয়া মন অধিকতর একাগ্র হইবার অবলম্বন পাইতেছে না অনুভব করিয়া তাঁহাকে কি কর্তব্য জিজ্ঞাসা করিলে তিনি ঐরূপ স্থলে স্বয়ং কিরূপ করিয়াছিলেন তাহা আমাদিগকে জানাইয়া ঐ বিষয়ে নানা কৌশল বলিয়া দিতেন। আমার স্মরণ হয়, শেষ রাত্রিতে ধ্যান করিতে বসিয়া আলমবাজারে অবস্থিত চটের কলের বাঁশির শব্দে মন লক্ষ্যভ্রষ্ট ও বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িত। তাঁহাকে ঐ কথা বলায় তিনি ঐ বাঁশির শব্দতেই মন একাগ্র করিতে বলিয়াছিলেন এবং ঐরূপ করিয়া বিশেষ ফল পাইয়াছিলাম। আর এক সময়ে ধ্যান করিবার কালে শরীর ভুলিয়া মনকে লক্ষ্যে সমাহিত করিবার পথে বিশেষ বাধা অনুভব করিয়া তাঁহার নিকটে উপস্থিত হইলে তিনি বেদান্তোক্ত সমাধিসাধনকালে শ্রীমৎ তোতাপুরীর দ্বারা ভ্রূমধ্যে মন একাগ্র করিতে যে ভাবে আদিষ্ট হইয়াছিলেন, সেই কথার উল্লেখ পুরঃসর নিজ নখাগ্র দ্বারা আমার ভ্রূমধ্যে তীব্র আঘাত করিয়া বলিয়াছিলেন, 'ঐ বেদনার উপর মনকে একাগ্র কর।' ফলে দেখিয়াছিলাম, ঐরূপে ঐ আঘাতজনিত বেদনার অনুভবটা যতক্ষণ ইচ্ছা সমভাবে মনে ধারণ করিয়া রাখিতে পারা যায় এবং ঐ কালে শরীরের অপর কোন অংশে মন বিক্ষিপ্ত হওয়া দূরে থাকুক ঐ অংশসকলের অস্তিত্বের কথা এককালে ভুলিয়া যাওয়া যায়। ঠাকুরের সাধনার স্থল, নির্জন পঞ্চবটীতলই আমাদিগের ধ্যান-ধারণা করিবার বিশেষ উপযোগী স্থান ছিল। শুদ্ধ ধ্যান-ধারণা কেন, ক্রীড়াকৌতুকেও আমরা অনেক সময় ঐ স্থানে অতিবাহিত করিতাম। ঐসকল সময়েও ঠাকুর আমাদিগের সহিত যথাসম্ভব যোগদান করিয়া আমাদিগের আনন্দবর্ধন করিতেন! আমরা তথায় দৌড়াদৌড়ি করিতাম, গাছে চড়িতাম, দৃঢ় রজ্জুর ন্যায় লম্বমান মাধবীলতার আবেষ্টনে বসিয়া দোল খাইতাম, এবং কখনও কখনও আপনারা রন্ধনাদি করিয়া ঐ স্থলে চড়ুইভাতি করিতাম। চড়ুইভাতির প্রথম দিনে আমি স্বহস্তে পাক করিয়াছি দেখিয়া ঠাকুর স্বয়ং ঐ অন্নব্যঞ্জনাদি গ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণেতর বর্ণের হস্তপক্ব অন্ন গ্রহণ করিতে পারেন না জানিয়া আমি তাঁহার নিমিত্ত ঠাকুরবাড়ির প্রসাদী অন্নের বন্দোবস্ত করিতেছিলাম। কিন্তু তিনি ঐরূপ করিতে নিষেধ করিয়া বলিয়াছিলেন, 'তোর মতো শুদ্ধসত্ত্বগুণীর হাতে ভাত খেলে কোন দোষ হবে না।' আমি উহা দিতে বারংবার আপত্তি করিলেও তিনি আমার কথা না শুনিয়া আমার হস্তপক্ব অন্ন সেদিন গ্রহণ করিয়াছিলেন।"
৬ ভবনাথ ও নরেন্দ্রের বরাহনগরের বন্ধুগণ
শ্রীযুত ভবনাথ চট্টোপাধ্যায় নামক একজন প্রিয়দর্শন ভক্তিমান যুবক ইতোমধ্যে দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে আগমনপূর্বক নরেন্দ্রনাথের সহিত পরিচিত ও বিশেষ সৌহার্দ্যবন্ধনে আবদ্ধ হইয়াছিল। বিনয়, নম্রতা, সরলতা ও বিশ্বাস-ভক্তির জন্য ভবনাথ ঠাকুরের বিশেষ প্রিয় হইয়াছিল। তাহার রমণীর ন্যায় কোমল স্বভাব এবং নরেন্দ্রনাথের প্রতি অসাধারণ ভালবাসা দেখিয়া ঠাকুর কখনও কখনও রহস্য করিয়া বলিতেন, "জন্মান্তরে তুই নরেন্দ্রের জীবনসঙ্গিনী ছিলি বোধ হয়।" ভবনাথ বরাহনগরে থাকিত এবং সুবিধা পাইলেই নরেন্দ্রনাথকে নিজ বাটীতে আনয়ন করিয়া আহারাদি করাইত। তাহার প্রতিবেশী সাতকড়ি লাহিড়ী নরেন্দ্রের সহিত বিশেষরূপে পরিচিত এবং দাশরথি সান্যাল তাঁহার সহপাঠী বন্ধু ছিলেন। ইঁহারাও নরেন্দ্রকে পাইলে দিবারাত্র তাঁহার সহিত অতিবাহিত করিতেন। ঐরূপে দক্ষিণেশ্বরে গমনাগমনকালে এবং কখনও কখনও বিশেষভাবে নিমন্ত্রিত হইয়া নরেন্দ্রনাথ বরাহনগরে এইসকল বন্ধুবর্গের সহিত মধ্যে মধ্যে কয়েক ঘণ্টা কাল অথবা দুই-এক দিবস অতিবাহিত করিতেন।
৭ পিতার সহসা মৃত্যুর কথা নরেন্দ্রের বরাহনগরে শুনা
১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দের প্রথমভাগে বি.এ. পরীক্ষার ফলাফল জানিতে পারিবার কিছু পূর্বে ঘটনাচক্রে নরেন্দ্রনাথের জীবনে বিশেষ পরিবর্তন আসিয়া উপস্থিত হইল। অত্যধিক পরিশ্রমে তাঁহার পিতা বিশ্বনাথের শরীর ইতঃপূর্বে অবসন্ন হইয়াছিল; এখন সহসা এক দিবস রাত্রি আন্দাজ ১০টার সময় তিনি হৃদ্রোগে মৃত্যুমুখে পতিত হইলেন। নরেন্দ্র সেই দিবস নিমন্ত্রিত হইয়া অপরাহ্ণে তাঁহার বরাহনগরের বন্ধুবর্গের নিকটে গমন করিয়াছিলেন এবং রাত্রি প্রায় এগারটা পর্যন্ত ভজনাদিতে অতিবাহিত করিয়া আহারান্তে তাঁহাদিগের সহিত এক ঘরে শয়নপূর্বক নানাবিধ আলাপে নিযুক্ত ছিলেন। তাঁহার বন্ধু 'হেমালী' রাত্রি প্রায় দুইটার সময় ঐ স্থলে আগমনপূর্বক তাঁহাকে ঐ নিদারুণ বার্তা শ্রবণ করাইলেন এবং তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া তৎক্ষণাৎ কলিকাতায় ফিরিলেন।
৮ নরেন্দ্রের সাংসারিক অবস্থার শোচনীয় পরিবর্তন
বাটীতে ফিরিয়া নরেন্দ্রনাথ পিতার ঔর্ধ্বদেহিক ক্রিয়া সম্পন্ন করিলেন, পরে অনুসন্ধানে বুঝিতে পারিলেন তাঁহাদিগের সাংসারিক অবস্থা অতীব শোচনীয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। পিতা কিছু রাখিয়া যাওয়া দূরে থাকুক, আয়ের অপেক্ষা নিত্য অধিক ব্যয় করিয়া কিছু ঋণ রাখিয়া গিয়াছেন; আত্মীয়বর্গ তাঁহার পিতার সহায়তায় নিজ নিজ অবস্থার উন্নতিসাধন করিয়া লইয়া এখন সময় বুঝিয়া শত্রুতাসাধনে এবং বসতবাটী হইতে পর্যন্ত তাঁহাদিগের উচ্ছেদ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছে; সংসারে আয় একপ্রকার নাই বলিলেই হয়, অথচ পাঁচ-সাতটি প্রাণীর ভরণ-পোষণাদি নিত্য নির্বাহ হওয়া আবশ্যক। চিরসুখপালিত নরেন্দ্রনাথ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া নানা স্থানে চাকরির অন্বেষণে ফিরিতে লাগিলেন। কিন্তু সময় যখন মন্দ পড়ে মানবের শত চেষ্টাতেও তখন কিছুমাত্র ফলোদয় হয় না! নরেন্দ্র সর্বত্র বিফলমনোরথ হইতে লাগিলেন।
৯ ঐ অবস্থা সম্বন্ধে নরেন্দ্রের কথা — চাকরির অন্বেষণ, পরিচিত ধনী ব্যক্তিদিগের অবজ্ঞা
পিতার মৃত্যুর পরে এক দুই করিয়া তিন-চারি মাস গত হইল, কিন্তু দুঃখ-দুর্দিনের অবসান হওয়া দূরে থাকুক আশার রক্তিম ছটায় নরেন্দ্রনাথের জীবনাকাশ ঈষন্মাত্রও রঞ্জিত হইল না। বাস্তবিক, এমন নিবিড় অন্ধকারে তাঁহার জীবন আর কখনও আচ্ছন্ন হইয়াছিল কিনা সন্দেহ। এই কালের আলোচনা করিয়া তিনি কখনও কখনও আমাদিগকে বলিয়াছেন:
"মৃতাশৌচের অবসান হইবার পূর্ব হইতেই কর্মের চেষ্টায় ফিরিতে হইয়াছিল। অনাহারে নগ্নপদে চাকরির আবেদন হস্তে লইয়া মধ্যাহ্নের প্রখর রৌদ্রে আফিস হইতে আফিসান্তরে ঘুরিয়া বেড়াইতাম — অন্তরঙ্গ বন্ধুগণের কেহ কেহ দুঃখের দুঃখী হইয়া কোন দিন সঙ্গে থাকিত, কোন দিন থাকিতে পারিত না, কিন্তু সর্বত্রই বিফলমনোরথ হইয়া ফিরিতে হইয়াছিল। সংসারের সহিত এই প্রথম পরিচয়েই বিশেষভাবে হৃদয়ঙ্গম হইতেছিল, স্বার্থশূন্য সহানুভূতি এখানে অতীব বিরল — দুর্বলের, দরিদ্রের এখানে স্থান নাই। দেখিতাম, দুই দিন পূর্বে যাহারা আমাকে কোন বিষয়ে কিছুমাত্র সহায়তা করিবার অবসর পাইলে আপনাদিগকে ধন্য জ্ঞান করিয়াছে, সময় বুঝিয়া তাহারাই এখন আমাকে দেখিয়া মুখ বাঁকাইতেছে এবং ক্ষমতা থাকিলেও সাহায্য করিতে পশ্চাৎপদ হইতেছে। দেখিয়া শুনিয়া কখনও কখনও সংসারটা দানবের রচনা বলিয়া মনে হইত। মনে হয়, এই সময়ে একদিন রৌদ্রে ঘুরিতে ঘুরিতে পায়ের তলায় ফোস্কা হইয়াছিল এবং নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া গড়ের মাঠে মনুমেন্টের ছায়ায় বসিয়া পড়িয়াছিলাম। দুই-একজন বন্ধু সেদিন সঙ্গে ছিল, অথবা ঘটনাক্রমে ঐ স্থানে আমার সহিত মিলিত হইয়াছিল। তন্মধ্যে একজন বোধ হয় আমাকে সান্ত্বনা দিবার জন্য গাহিয়াছিল —
'বহিছে কৃপাঘন ব্রহ্মনিঃশ্বাস পবনে' ইত্যাদি।
শুনিয়া মনে হইয়াছিল মাথায় যেন সে গুরুতর আঘাত করিতেছে। মাতা ও ভ্রাতাগণের নিতান্ত অসহায় অবস্থার কথা মনে উদয় হইয়া ক্ষোভে, নিরাশায়, অভিমানে বলিয়া উঠিয়াছিলাম, 'নে, নে, চুপ কর, ক্ষুধার তাড়নায় যাহাদিগের আত্মীয়বর্গকে কষ্ট পাইতে হয় না, গ্রাসাচ্ছাদনের অভাব যাহাদিগকে কখনও সহ্য করিতে হয় নাই, টানাপাখার হাওয়া খাইতে খাইতে তাহাদিগের নিকটে ঐরূপ কল্পনা মধুর লাগিতে পারে, আমারও একদিন লাগিত; কঠোর সত্যের সম্মুখে উহা এখন বিষম ব্যঙ্গ বলিয়া বোধ হইতেছে।'"
"আমার ঐরূপ কথায় উক্ত বন্ধু বোধ হয় নিতান্ত ক্ষুণ্ণ হইয়াছিল — দারিদ্র্যের কিরূপ কঠোর পেষণে মুখ হইতে ঐ কথা নির্গত হইয়াছিল তাহা সে বুঝিবে কেমনে! প্রাতঃকালে উঠিয়া গোপনে অনুসন্ধান করিয়া যেদিন বুঝিতাম গৃহে সকলের প্রচুর আহার্য নাই এবং হাতে পয়সা নাই, সেদিন মাতাকে 'আমার নিমন্ত্রণ আছে' বলিয়া বাহির হইতাম এবং কোন দিন সামান্য কিছু খাইয়া, কোন দিন অনশনে কাটাইয়া দিতাম। অভিমানে, ঘরে বাহিরে কাহারও নিকটে ঐ কথা প্রকাশ করিতেও পারিতাম না। ধনী বন্ধুগণের অনেকে পূর্বের ন্যায় আমাকে তাহাদিগের গৃহে বা উদ্যানে লইয়া যাইয়া সঙ্গীতাদি দ্বারা তাহাদিগের আনন্দবর্ধনে অনুরোধ করিত। এড়াইতে না পারিয়া মধ্যে মধ্যে তাহাদিগের সহিত গমনপূর্বক তাহাদিগের মনোরঞ্জনে প্রবৃত্ত হইতাম, কিন্তু অন্তরের কথা তাহাদিগের নিকটে প্রকাশ করিতে প্রবৃত্তি হইত না — তাহারাও স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া ঐ বিষয় জানিতে কখনও সচেষ্ট হয় নাই। তাহাদিগের মধ্যে বিরল দুই-একজন কখনও কখনও বলিত, 'তোকে আজ এত বিষণ্ণ ও দুর্বল দেখিতেছি কেন, বল দেখি?' একজন কেবল আমার অজ্ঞাতে অন্যের নিকট হইতে আমার অবস্থা জানিয়া লইয়া বেনামী পত্রমধ্যে মাতাকে সময়ে সময়ে টাকা পাঠাইয়া আমাকে চিরঋণে আবদ্ধ করিয়াছিল।"
"যৌবনে পদার্পণপূর্বক যে-সকল বাল্যবন্ধু চরিত্রহীন হইয়া অসদুপায়ে যৎসামান্য উপার্জন করিতেছিল, তাহাদিগের কেহ কেহ আমার দারিদ্র্যের কথা জানিতে পারিয়া সময় বুঝিয়া দলে টানিতে সচেষ্ট হইয়াছিল। তাহাদিগের মধ্যে যাহারা ইতিপূর্বে আমার ন্যায় অবস্থার পরিবর্তনে সহসা পতিত হইয়া একরূপ বাধ্য হইয়াই জীবনযাত্রা নির্বাহের জন্য হীন পথ অবলম্বন করিয়াছিল, দেখিতাম তাহারা সত্য সত্যই আমার জন্য ব্যথিত হইয়াছে। সময় বুঝিয়া অবিদ্যারূপিণী মহামায়াও এই কালে পশ্চাতে লাগিতে ছাড়েন নাই। এক সঙ্গতিপন্না রমণীর পূর্ব হইতে আমার উপর নজর পড়িয়াছিল। অবসর বুঝিয়া সে এখন প্রস্তাব করিয়া পাঠাইল, তাহার সহিত তাহার সম্পত্তি গ্রহণ করিয়া দারিদ্র্যদুঃখের অবসান করিতে পারি! বিষম অবজ্ঞা ও কঠোরতাপ্রদর্শনে তাহাকে নিবৃত্ত করিতে হইয়াছিল। অন্য এক রমণী ঐরূপ প্রলোভিত করিতে আসিলে তাহাকে বলিয়াছিলাম, 'বাছা, এই ছাই-ভস্ম শরীরটার তৃপ্তির জন্য এতদিন কত কি তো করিলে, মৃত্যু সম্মুখে — তখনকার সম্বল কিছু করিয়াছ কি? হীন বুদ্ধি ছাড়িয়া ভগবানকে ডাক।'"
১২ ঈশ্বরের নাম লওয়ায় মাতার তিরস্কার
"যাহা হউক এত দুঃখকষ্টেও এতদিন আস্তিক্যবুদ্ধির বিলোপ অথবা 'ঈশ্বর মঙ্গলময়' — এ কথায় সন্দিহান হই নাই। প্রাতে নিদ্রাভঙ্গে তাঁহাকে স্মরণ-মননপূর্বক তাঁহার নাম করিতে করিতে শয্যা ত্যাগ করিতাম এবং আশায় বুক বাঁধিয়া উপার্জনের উপায় অন্বেষণে ঘুরিয়া বেড়াইতাম। একদিন ঐরূপে শয্যা ত্যাগ করিতেছি এমন সময়ে পার্শ্বের ঘর হইতে মাতা শুনিতে পাইয়া বলিয়া উঠিলেন, 'চুপ কর ছোঁড়া, ছেলেবেলা থেকে কেবল ভগবান ভগবান — ভগবান তো সব করলেন!' কথাগুলিতে মনে বিষম আঘাত প্রাপ্ত হইলাম। স্তম্ভিত হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, ভগবান কি বাস্তবিক আছেন, এবং থাকিলেও মানবের সকরুণ প্রার্থনা কি শুনিয়া থাকেন? তবে এত যে প্রার্থনা করি তাহার কোনরূপ উত্তর নাই কেন? শিবের সংসারে এত অ-শিব কোথা হইতে আসিল — মঙ্গলময়ের রাজত্বে এতপ্রকার অমঙ্গল কেন? বিদ্যাসাগর মহাশয় পরদুঃখে কাতর হইয়া এক সময় যাহা বলিয়াছিলেন — ভগবান যদি দয়াময় ও মঙ্গলময়, তবে দুর্ভিক্ষের করাল কবলে পতিত হইয়া লাখ লাখ লোক দুটি অন্ন না পাইয়া মরে কেন? — তাহা কঠোর ব্যঙ্গস্বরে কর্ণে প্রতিধ্বনিত হইতে লাগিল। ঈশ্বরের প্রতি প্রচণ্ড অভিমানে হৃদয় পূর্ণ হইল, অবসর বুঝিয়া সন্দেহ আসিয়া অন্তর অধিকার করিল।"
"গোপনে কোন কার্যের অনুষ্ঠান করা আমার প্রকৃতিবিরুদ্ধ ছিল। বাল্যকাল হইতে কখনও ঐরূপ করা দূরে থাকুক, অন্তরের চিন্তাটি পর্যন্ত ভয়ে বা অন্য কোন কারণে কাহারও নিকটে কখনও লুকাইবার অভ্যাস করি নাই। সুতরাং ঈশ্বর নাই, অথবা যদি থাকেন তো তাঁহাকে ডাকিবার কোন সফলতা এবং প্রয়োজন নাই, এ কথা হাঁকিয়া-ডাকিয়া লোকের নিকটে সপ্রমাণ করিতে এখন অগ্রসর হইব, ইহাতে বিচিত্র কি? ফলে স্বল্প দিনেই রব উঠিল, আমি নাস্তিক হইয়াছি এবং দুশ্চরিত্র লোকের সহিত মিলিত হইয়া মদ্যপানে ও বেশ্যালয়ে পর্যন্ত গমনে কুণ্ঠিত নহি! সঙ্গে সঙ্গে আমারও আবাল্য অনাশ্রব হৃদয় অযথা নিন্দায় কঠিন হইয়া উঠিল এবং কেহ জিজ্ঞাসা না করিলেও সকলের নিকটে বলিয়া বেড়াইতে লাগিল, এই দুঃখ-কষ্টের সংসারে নিজ দুরদৃষ্টের কথা কিছুক্ষণ ভুলিয়া থাকিবার জন্য যদি কেহ মদ্যপান করে, অথবা বেশ্যাগৃহে গমন করিয়া আপনাকে সুখী জ্ঞান করে, তাহাতে আমার যে বিন্দুমাত্র আপত্তি নাই তাহাই নহে, কিন্তু ঐরূপ করিয়া আমিও তাহাদিগের ন্যায় ক্ষণিক সুখভোগী হইতে পারি — এ কথা যেদিন নিঃসংশয়ে বুঝিতে পারিব সেদিন আমিও ঐরূপ করিব, কাহারও ভয়ে পশ্চাৎপদ হইব না।"
১৪ নরেন্দ্রের অধঃপতনে ভক্তগণের বিশ্বাস হইলেও ঠাকুরের অন্যরূপ ধারণা
"কথা কানে হাঁটে। আমার ঐসকল কথা নানারূপে বিকৃত হইয়া দক্ষিণেশ্বরে ঠাকুরের নিকটে এবং তাঁহার কলিকাতাস্থ ভক্তগণের কাছে পৌঁছিতে বিলম্ব হইল না। কেহ কেহ আমার স্বরূপ অবস্থা নির্ণয় করিতে দেখা করিতে আসিলেন এবং যাহা রটিয়াছে তাহা সম্পূর্ণ না হইলেও কতকটা তাঁহারা বিশ্বাস করিতে প্রস্তুত, ইঙ্গিতে-ইশারায় জানাইলেন। আমাকে তাঁহারা এতদূর হীন ভাবিতে পারেন জানিয়া আমিও দারুণ অভিমানে স্ফীত হইয়া দণ্ড পাইবার ভয়ে ঈশ্বরে বিশ্বাস করা বিষম দুর্বলতা, এ কথা প্রতিপন্নপূর্বক হিউম, বেন, মিল, কোঁতে প্রভৃতি পাশ্চাত্য দার্শনিকসকলের মতামত উদ্ধৃত করিয়া ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ নাই বলিয়া তাঁহাদিগের সহিত প্রচণ্ড তর্ক জুড়িয়া দিলাম। ফলে বুঝিতে পারিলাম আমার অধঃপতন হইয়াছে, এ কথায় বিশ্বাস দৃঢ়তর করিয়া তাঁহারা বিদায়গ্রহণ করিলেন। বুঝিয়া আনন্দিত হইলাম এবং ভাবিলাম ঠাকুরও হয়তো ইঁহাদের মুখে শুনিয়া এরূপ বিশ্বাস করিবেন। ঐরূপ ভাবিবামাত্র আবার নিদারুণ অভিমানে অন্তর পূর্ণ হইল। স্থির করিলাম, তা করুন — মানুষের ভালমন্দ মতামতের যখন এতই অল্প মূল্য, তখন তাহাতে আসে যায় কি? পরে শুনিয়া স্তম্ভিত হইলাম, ঠাকুর তাঁহাদিগের মুখে ঐ কথা শুনিয়া প্রথমে হাঁ, না কিছুই বলেন নাই; পরে ভবনাথ রোদন করিতে করিতে তাঁহাকে ঐ কথা জানাইয়া যখন বলিয়াছিল, 'মহাশয়, নরেন্দ্রের এমন হইবে এ কথা স্বপ্নেরও অগোচর!' — তখন বিষম উত্তেজিত হইয়া তিনি তাহাকে বলিয়াছিলেন, 'চুপ কর শালারা, মা বলিয়াছেন সে কখনও ঐরূপ হইতে পারে না; আর কখনও আমাকে ঐসব কথা বলিলে তোদের মুখ দেখিতে পারিব না!'"
"ঐরূপে অহঙ্কারে অভিমানে নাস্তিকতার পোষণ করিলে হইবে কি? পরক্ষণেই বাল্যকাল হইতে, বিশেষতঃ ঠাকুরের সহিত সাক্ষাতের পরে, জীবনে যে-সকল অদ্ভুত অনুভূতি উপস্থিত হইয়াছিল, সেইসকলের কথা উজ্জ্বল বর্ণে মনে উদয় হওয়ায় ভাবিতে থাকিতাম — ঈশ্বর নিশ্চয় আছেন এবং তাঁহাকে লাভ করিবার পথও নিশ্চয় আছে, নতুবা এই সংসারে প্রাণধারণের কোনই আবশ্যকতা নাই; দুঃখকষ্ট জীবনে যতই আসুক না কেন, সেই পথ খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। ঐরূপে দিনের পর দিন যাইতে লাগিল এবং সংশয়ে চিত্ত নিরন্তর দোলায়মান হইয়া শান্তি সুদূরপরাহতা হইয়া রহিল — সাংসারিক অভাবেরও হ্রাস হইল না।"
১৬ অদ্ভুত দর্শনে নরেন্দ্রের শান্তি
"গ্রীষ্মের পর বর্ষা আসিল। এখনও পূর্বের ন্যায় কর্মের অনুসন্ধানে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। একদিন সমস্ত দিবস উপবাসে ও বৃষ্টিতে ভিজিয়া রাত্রে অবসন্ন পদে এবং ততোধিক অবসন্ন মনে বাটীতে ফিরিতেছি, এমন সময়ে শরীরে এত ক্লান্তি অনুভব করিলাম যে, আর এক পদও অগ্রসর হইতে না পারিয়া পার্শ্বস্থ বাটীর রকে জড় পদার্থের ন্যায় পড়িয়া রহিলাম। কিছুক্ষণের জন্য চেতনার লোপ হইয়াছিল কিনা বলিতে পারি না। এটা কিন্তু স্মরণ আছে, মনে নানা বর্ণের চিন্তা ও ছবি তখন আপনা হইতে পর পর উদয় ও লয় হইতেছিল এবং উহাদিগকে তাড়াইয়া কোন এক চিন্তাবিশেষে মনকে আবদ্ধ রাখিব এরূপ সামর্থ্য ছিল না। সহসা উপলব্ধি করিলাম, কোন এক দৈবশক্তিপ্রভাবে একের পর অন্য এইরূপে ভিতরের অনেকগুলি পর্দা যেন উত্তোলিত হইল এবং শিবের সংসারে অ-শিব কেন, ঈশ্বরের কঠোর ন্যায়পরতা ও অপার করুণার সামঞ্জস্য প্রভৃতি যে-সকল বিষয় নির্ণয় করিতে না পারিয়া মন এতদিন নানা সন্দেহে আকুল হইয়াছিল, সেইসকল বিষয়ের স্থির মীমাংসা অন্তরের নিবিড়তম প্রদেশে দেখিতে পাইলাম। আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া উঠিলাম। অনন্তর বাটী ফিরিবার কালে দেখিলাম, শরীরে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নাই, মন অমিত বল ও শান্তিতে পূর্ণ এবং রজনী অবসান হইবার স্বল্পই বিলম্ব আছে।"
১৭ সন্ন্যাসী হইবার সঙ্কল্প ও দক্ষিণেশ্বরে আগমনে ঠাকুরের অদ্ভুত আচরণ
"সংসারের প্রশংসা ও নিন্দায় এখন হইতে এককালে উদাসীন হইলাম এবং ইতরসাধারণের ন্যায় অর্থোপার্জন করিয়া পরিবারবর্গের সেবা ও ভোগসুখে কালযাপন করিবার জন্য আমার জন্ম হয় নাই — এ কথায় দৃঢ়বিশ্বাসী হইয়া পিতামহের ন্যায় সংসারত্যাগের জন্য গোপনে প্রস্তুত হইতে লাগিলাম। যাইবার দিন স্থির হইলে সংবাদ পাইলাম, ঠাকুর ঐদিন কলিকাতায় জনৈক ভক্তের বাটীতে আসিতেছেন। ভাবিলাম — ভালই হইল, গুরুদর্শন করিয়া চিরকালের মতো গৃহত্যাগ করিব। ঠাকুরের সহিত সাক্ষাৎ হইবামাত্র তিনি ধরিয়া বসিলেন, 'তোকে আজ আমার সহিত দক্ষিণেশ্বরে যাইতে হইবে।' নানা ওজর করিলাম। তিনি কিছুতেই ছাড়িলেন না। অগত্যা তাঁহার সঙ্গে চলিলাম। গাড়িতে তাঁহার সহিত বিশেষ কোন কথা হইল না। দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছিয়া অন্য সকলের সহিত কিছুক্ষণ তাঁহার গৃহমধ্যে উপবিষ্ট রহিয়াছি এমন সময়ে ঠাকুরের ভাবাবেশ হইল। দেখিতে দেখিতে তিনি সহসা নিকটে আসিয়া আমাকে সস্নেহে ধারণপূর্বক সজল নয়নে গাহিতে লাগিলেন —"
কথা কহিতে ডরাই
না কহিতেও ডরাই,
(আমার) মনে সন্দ হয়
বুঝি তোমায় হারাই, হা-রাই!
১৮ ঠাকুরের অনুরোধে নিরুদ্দেশ হইবার সঙ্কল্প পরিত্যাগ
"অন্তরের প্রবল ভাবরাশি এতক্ষণ সযত্নে রুদ্ধ রাখিয়াছিলাম, আর বেগ সংবরণ করিতে পারিলাম না — ঠাকুরের ন্যায় আমারও বক্ষ নয়নধারায় প্লাবিত হইতে লাগিল। নিশ্চয় বুঝিলাম, ঠাকুর সকল কথা জানিতে পারিয়াছেন! আমাদিগের ঐরূপ আচরণে অন্য সকলে স্তম্ভিত হইয়া রহিল। প্রকৃতিস্থ হইবার পরে কেহ কেহ ঠাকুরকে উহার কারণ জিজ্ঞাসা করায় তিনি ঈষৎ হাস্য করিয়া বলিলেন, 'আমাদের ও একটা হয়ে গেল।' পরে রাত্রে অপর সকলকে সরাইয়া আমাকে নিকটে ডাকিয়া বলিলেন, 'জানি আমি, তুমি মার কাজের জন্য আসিয়াছ, সংসারে কখনই থাকিতে পারিবে না, কিন্তু আমি যতদিন আছি ততদিন আমার জন্য থাক!' — বলিয়াই ঠাকুর হৃদয়ের আবেগে রুদ্ধকণ্ঠে, পুনরায় অশ্রু বিসর্জন করিতে লাগিলেন!"
১৯ দৈব সহায়তায় দারিদ্র্য-মোচনের সঙ্কল্প ও সেজন্য ঠাকুরকে জেদ করায়, তাঁহার 'কালীঘরে' যাইয়া প্রার্থনা করিতে বলা
"ঠাকুরের নিকটে বিদায় গ্রহণ করিয়া পরদিন বাটীতে ফিরিলাম, সঙ্গে সঙ্গে সংসারের শতচিন্তা আসিয়া অন্তর অধিকার করিল। পূর্বের ন্যায় নানা চেষ্টায় ফিরিতে লাগিলাম। ফলে 'এটর্নি'র আফিসে পরিশ্রম করিয়া এবং কয়েকখানি পুস্তকের অনুবাদ প্রভৃতিতে সামান্য উপার্জন হইয়া কোনরূপে দিন কাটিয়া যাইতে লাগিল বটে, কিন্তু স্থায়ী কোনরূপ কর্ম জুটিল না এবং মাতা ও ভ্রাতাদিগের ভরণ-পোষণের একটা সচ্ছল বন্দোবস্তও হইয়া উঠিল না। কিছুকাল পরে মনে হইল, ঠাকুরের কথা তো ঈশ্বর শুনেন — তাঁহাকে অনুরোধ করিয়া মাতা ও ভ্রাতাদিগের খাওয়া-পরার কষ্ট যাহাতে দূর হয় এরূপ প্রার্থনা করাইয়া লইব; আমার জন্য ঐরূপ করিতে তিনি কখনই অস্বীকার করিবেন না। দক্ষিণেশ্বরে ছুটিলাম এবং নাছোড়বান্দা হইয়া ঠাকুরকে ধরিয়া বসিলাম, 'মা-ভাইদের আর্থিক কষ্ট নিবারণের জন্য আপনাকে মাকে জানাইতে হইবে।' ঠাকুর বলিলেন, 'ওরে, আমি যে ওসব কথা বলতে পারি না। তুই যা না কেন? মাকে মানিস না — সেইজন্যই তোর এত কষ্ট!' বলিলাম, 'আমি তো মাকে জানি না, আপনি আমার জন্য মাকে বলুন — বলতেই হবে, আমি কিছুতেই আপনাকে ছাড়ব না।' ঠাকুর সস্নেহে বলিলেন, 'ওরে, আমি যে কতবার বলেছি, মা, নরেন্দ্রের দুঃখ কষ্ট দূর কর; তুই মাকে মানিস না। সেইজন্যই তো মা শুনে না। আচ্ছা, আজ মঙ্গলবার, আমি বলছি, আজ রাত্রে 'কালীঘর'-এ গিয়ে মাকে প্রণাম করে তুই যা চাইবি, মা তোকে তাই দিবেন। মা আমার চিন্ময়ী ব্রহ্মশক্তি, ইচ্ছায় জগৎ প্রসব করিয়াছেন — তিনি ইচ্ছা করিলে কি না করিতে পারেন!'"
২০ জগদম্বার দর্শনে সংসার-বিস্মৃতি
"দৃঢ় বিশ্বাস হইল, ঠাকুর যখন ঐরূপ বলিলেন, তখন নিশ্চয় প্রার্থনামাত্র সকল দুঃখের অবসান হইবে। প্রবল উৎকণ্ঠায় রাত্রির প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম। ক্রমে রাত্রি হইল। এক প্রহর গত হইবার পরে ঠাকুর আমাকে শ্রীমন্দিরে যাইতে বলিলেন। যাইতে যাইতে একটা গাঢ় নেশায় সমাচ্ছন্ন হইয়া পড়িলাম, পা টলিতে লাগিল, এবং মাকে সত্য সত্য দেখিতে ও তাঁহার শ্রীমুখের বাণী শুনিতে পাইব, এইরূপ স্থির বিশ্বাসে মন অন্য সকল বিষয় ভুলিয়া বিষম একাগ্র ও তন্ময় হইয়া ঐ কথাই ভাবিতে লাগিল। মন্দিরে উপস্থিত হইয়া দেখিলাম, সত্য সত্যই মা চিন্ময়ী, সত্য সত্যই জীবিতা এবং অনন্ত প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রস্রবণস্বরূপিণী। ভক্তি-প্রেমে হৃদয় উচ্ছ্বসিত হইল, বিহ্বল হইয়া বারংবার প্রণাম করিতে করিতে বলিতে লাগিলাম, 'মা বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও, জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও, যাহাতে তোমার অবাধ-দর্শন নিত্য লাভ করি এইরূপ করিয়া দাও!' — শান্তিতে প্রাণ আপ্লুত হইল, জগৎ-সংসার নিঃশেষে অন্তর্হিত হইয়া একমাত্র মা-ই হৃদয় পূর্ণ করিয়া রহিলেন!"
২১ তিন বার 'কালীঘরে' আর্থিক উন্নতি প্রার্থনা করিতে গমন ও ভিন্ন ভাবের আচরণ
"ঠাকুরের নিকটে ফিরিবামাত্র তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, 'কিরে, মার নিকটে সাংসারিক অভাব দূর করিবার প্রার্থনা করিয়াছিস তো?' তাঁহার প্রশ্নে চমকিত হইয়া বলিলাম, 'না মহাশয়, ভুলিয়া গিয়াছি! তাই তো, এখন কি করি?' তিনি বলিলেন, 'যা, যা, ফের যা, গিয়ে ঐ কথা জানিয়ে আয়।' পুনরায় মন্দিরে চলিলাম এবং মার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া পুনরায় মোহিত হইয়া সকল কথা ভুলিয়া পুনঃপুনঃ প্রণামপূর্বক জ্ঞান-ভক্তি লাভের জন্য প্রার্থনা করিয়া ফিরিলাম। ঠাকুর হাসিতে হাসিতে বলিলেন, 'কি রে, এবার বলিয়াছিস তো?' আবার চমকিত হইয়া বলিলাম, 'না মহাশয়, মাকে দেখিবামাত্র কি এক দৈবীশক্তিপ্রভাবে সব কথা ভুলিয়া কেবল জ্ঞান-ভক্তি লাভের কথাই বলিয়াছি! — কি হবে?' ঠাকুর বলিলেন, 'দূর ছোঁড়া, আপনাকে একটু সামলাইয়া ঐ প্রার্থনাটা করিতে পারিলি না? পারিস তো আর একবার গিয়ে ঐ কথাগুলো জানিয়ে আয়, শীঘ্র যা।' পুনরায় চলিলাম, কিন্তু মন্দিরে প্রবেশমাত্র দারুণ লজ্জা আসিয়া হৃদয় অধিকার করিল। ভাবিলাম, একি তুচ্ছ কথা মাকে বলিতে আসিয়াছি! ঠাকুর যে বলেন, রাজার প্রসন্নতা লাভ করিয়া তাঁহার নিকটে 'লাউ কুমড়া ভিক্ষা করা', এ যে সেইরূপ নির্বুদ্ধিতা! এমন হীনবুদ্ধি আমার! লজ্জায় ঘৃণায় পুনঃপুনঃ প্রণাম করিতে করিতে বলিতে লাগিলাম, 'অন্য কিছু চাহি না মা, কেবল জ্ঞান ভক্তি দাও!' মন্দিরের বাহিরে আসিয়া মনে হইল ইহা নিশ্চয়ই ঠাকুরের খেলা, নতুবা তিন তিনবার মার নিকটে আসিয়াও বলা হইল না। অতঃপর তাঁহাকে ধরিয়া বসিলাম, আপনিই নিশ্চিত আমাকে ঐরূপে ভুলাইয়া দিয়াছেন, এখন আপনাকে বলিতে হইবে, আমার মা-ভাইদের গ্রাসাচ্ছাদনের অভাব থাকিবে না। তিনি বলিলেন, 'ওরে, আমি যে কাহারও জন্য ঐরূপ প্রার্থনা কখনও করিতে পারি না, আমার মুখ দিয়া যে উহা বাহির হয় না। তোকে বললুম, মার কাছে যাহা চাহিবি তাহাই পাইবি; তুই চাহিতে পারিলি না, তোর অদৃষ্টে সংসারসুখ নাই, তা আমি কি করিব।' বলিলাম, 'তাহা হইবে না মহাশয়, আপনাকে আমার জন্য ঐ কথা বলিতেই হইবে; আমার দৃঢ় বিশ্বাস — আপনি বলিলেই তাহাদের আর কষ্ট থাকিবে না।' ঐরূপে যখন তাঁহাকে কিছুতেই ছাড়িলাম না, তখন তিনি বলিলেন, 'আচ্ছা যা, তাদের মোটা ভাত-কাপড়ের কখনও অভাব হবে না'।"
২২ নরেন্দ্রের প্রতীক ও প্রতিমায় ঈশ্বরোপাসনায় বিশ্বাস ও ঠাকুরের ঐজন্য আনন্দ
পূর্বে যাহা বলা হইল, নরেন্দ্রনাথের জীবনে উহা যে একটি বিশেষ ঘটনা, তাহা বলিতে হইবে না। ঈশ্বরের মাতৃভাবের এবং প্রতীক ও প্রতিমায় তাঁহাকে উপাসনা করিবার গূঢ় মর্ম এতদিন তাঁহার হৃদয়ঙ্গম হয় নাই। মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত দেবদেবীমূর্তিসকলকে তিনি ইতঃপূর্বে অবজ্ঞা ভিন্ন কখনও ভক্তিভরে দর্শন করিতে পারিতেন না। এখন হইতে ঐরূপ উপাসনার সম্যক রহস্য তাঁহার হৃদয়ে প্রতিভাসিত হইয়া তাঁহার আধ্যাত্মিক জীবনে অধিকতর পূর্ণতা ও প্রসারতা আনয়ন করিল। ঠাকুর উহাতে কিরূপ আনন্দিত হইয়াছিলেন তাহা বলিবার নহে। আমাদিগের জনৈক বন্ধু১ ঐ ঘটনার পরদিবসে দক্ষিণেশ্বরে আগমনপূর্বক যাহা দর্শন ও শ্রবণ করিয়াছিলেন, তাহা এখানে উল্লেখ করিলে পাঠক ঐ কথা বুঝিতে পারিবেন।
২৩ ঠাকুরের ঐ বিষয়ক আনন্দ সম্বন্ধে বৈকুণ্ঠনাথের কথা
"তারাপদ ঘোষ নামক এক ব্যক্তির সহিত এক আফিসে কর্ম করায় ইতঃপূর্বে পরিচিত হইয়াছিলাম। তারাপদের সহিত নরেন্দ্রনাথের বিশেষ বন্ধুতা ছিল। সেজন্য আফিসে তারাপদের নিকটে নরেন্দ্রকে ইতঃপূর্বে কখনও কখনও দেখিয়াছিলাম। তারাপদ একদিন কথায় কথায় বলিয়াও ছিল, পরমহংসদেব নরেনবাবুকে বিশেষ ভালবাসেন, তথাপি আমি নরেন্দ্রের সহিত পরিচিত হইবার চেষ্টা করি নাই। অদ্য মধ্যাহ্নে দক্ষিণেশ্বরে আসিয়া দেখিলাম, ঠাকুর একাকী গৃহে বসিয়া আছেন এবং নরেন্দ্র বাহিরে এক পার্শ্বে শয়ন করিয়া নিদ্রা যাইতেছেন। ঠাকুরের মুখ যেন আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া রহিয়াছে। নিকটে যাইয়া প্রণাম করিবামাত্র তিনি নরেন্দ্রনাথকে দেখাইয়া বলিলেন, 'ওরে দেখ, ঐ ছেলেটি বড় ভাল, ওর নাম নরেন্দ্র, আগে মাকে মানত না, কাল মেনেছে। কষ্টে পড়েছে, তাই মার কাছে টাকা-কড়ি চাইবার কথা বলে দিয়াছিলাম, তা কিন্তু চাইতে পারলে না — বলে, 'লজ্জা করলে!' মন্দির থেকে এসে আমাকে বললে মার গান শিখিয়ে দাও — 'মা ত্বং হি তারা' গানটি২ শিখিয়ে দিলাম। কাল সমস্ত রাত ঐ গানটা গেয়েছে! তাই এখন ঘুমুচ্ছে। (আহ্লাদে হাসিতে হাসিতে) নরেন্দ্র কালী মেনেছে, বেশ হয়েছে — না?' তাঁহার ঐ কথা লইয়া বালকের ন্যায় আনন্দ দেখিয়া বলিলাম, 'হ্যাঁ মহাশয়, বেশ হইয়াছে।' কিছুক্ষণ পরে পুনরায় হাসিতে হাসিতে বলিলেন, 'নরেন্দ্র মাকে মেনেছে! বেশ হয়েছে — কেমন?' ঐরূপে ঘুরাইয়া-ফিরাইয়া বারংবার ঐ কথা বলিয়া আনন্দ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।"
২৪ নরেন্দ্রকে ঠাকুরের বিশেষ আপনার জ্ঞানের পরিচায়ক দৃষ্টান্ত
"নিদ্রাভঙ্গে বেলা প্রায় ৪টার সময় নরেন্দ্র গৃহমধ্যে ঠাকুরের নিকটে আসিয়া উপবিষ্ট হইলেন। মনে হইল এইবার তিনি তাঁহার নিকটে বিদায় গ্রহণ করিয়া কলিকাতায় ফিরিবেন। ঠাকুর কিন্তু তাঁহাকে দেখিয়াই ভাবাবিষ্ট হইয়া তাঁহার গা ঘেঁষিয়া একপ্রকার তাঁহার ক্রোড়ে আসিয়া উপবিষ্ট হইলেন এবং বলিতে লাগিলেন, (আপনার শরীর ও নরেন্দ্রের শরীর পর পর দেখাইয়া) 'দেখছি কি — এটা আমি, আবার এটাও আমি; সত্য বলছি — কিছুই তফাত বুঝতে পারচি না! যেমন গঙ্গার জলে একটা লাঠি ফেলায় দুটো ভাগ দেখাচ্ছে — সত্য সত্য কিন্তু ভাগাভাগি নেই, একটাই রয়েছে! — বুঝতে পাচ্চ? তা মা ছাড়া আর কি আছে বল, কেমন?' ঐরূপে নানা কথা কহিয়া বলিয়া উঠিলেন, 'তামাক খাব।' আমি ত্রস্ত হইয়া তামাক সাজিয়া তাঁহার হুঁকাটি তাঁহাকে দিলাম। দুই-এক টান টানিয়াই তিনি হুঁকাটি ফিরাইয়া দিয়া 'কলকেতে খাব' বলিয়া কলকেটি হাতে লইয়া টানিতে লাগিলেন। দুই-চারি টান টানিয়া উহা নরেন্দ্রের মুখের কাছে ধরিয়া বলিলেন, 'খা, আমার হাতেই খা।' নরেন্দ্র ঐ কথায় বিষম সঙ্কুচিত হওয়ায় বলিলেন, 'তোর তো ভারী হীন বুদ্ধি — তুই আমি কি আলাদা? এটাও আমি, ওটাও আমি।' ঐ কথা বলিয়া নরেন্দ্রনাথকে তামাকু খাওয়াইয়া দিবার জন্য পুনরায় নিজ হাত দুইখানি তাঁহার মুখের সম্মুখে ধরিলেন। অগত্যা নরেন্দ্র ঠাকুরের হাতে মুখ লাগাইয়া দুই-তিনবার তামাক টানিয়া নিরস্ত হইলেন। ঠাকুর তাঁহাকে নিরস্ত দেখিয়া স্বয়ং পুনরায় তামাকু সেবন করিতে উদ্যত হইলেন। নরেন্দ্র ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, 'মহাশয়, হাতটা ধুইয়া তামাক খান।' কিন্তু সে কথা শুনে কে? 'দূর শালা, তোর তো ভারী ভেদবুদ্ধি' এই কথা বলিয়া ঠাকুর উচ্ছিষ্ট হস্তেই তামাক টানিতে ও ভাবাবেশে নানা কথা বলিতে লাগিলেন। খাদ্যদ্রব্যের অগ্রভাগ কাহাকেও দেওয়া হইলে যে ঠাকুর উহা উচ্ছিষ্ট জ্ঞানে কখনও খাইতে পারিতেন না, নরেন্দ্রের উচ্ছিষ্ট সম্বন্ধে তাঁহাকে অদ্য ঐরূপ ব্যবহার করিতে দেখিয়া আমি স্তম্ভিত হইয়া ভাবিতে লাগিলাম, নরেন্দ্রনাথকে ইনি কতদূর আপনার জ্ঞান করেন।"
২৫ নরেন্দ্রের সহিত বৈকুণ্ঠের কলিকাতায় আগমন
"কথায় কথায় রাত্রি প্রায় ৮টা বাজিয়া গেল। তখন ঠাকুরের ভাবের উপশম দেখিয়া নরেন্দ্র ও আমি তাঁহার নিকটে বিদায়গ্রহণপূর্বক পদব্রজে কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলাম। ইহার পরে কতদিন আমরা নরেন্দ্রনাথকে বলিতে শুনিয়াছি, 'একা ঠাকুরই কেবল আমাকে প্রথম দেখা হইতে সকল সময় সমভাবে বিশ্বাস করিয়া আসিয়াছেন, আর কেহই নহে — নিজের মা-ভাইরাও নহে। তাঁহার ঐরূপ বিশ্বাস ভালবাসাই আমাকে চিরকালের মতো বাঁধিয়া ফেলিয়াছে! একা তিনিই ভালবাসিতে জানিতেন ও পারিতেন — সংসারের অন্য সকলে স্বার্থসিদ্ধির জন্য ভালবাসার ভান মাত্র করিয়া ফিরিয়া থাকে'।"
১
শ্রীযুত বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল।
২
(আমার) মা ত্বং হি তারা।
তুমি ত্রিগুণধরা পরাৎপরা।
তোরে জানি মা ও দীনদয়াময়ী,
তুমি দুর্গমেতে দুঃখহরা॥
তুমি জলে, তুমি স্থলে,
তুমিই আদ্যমূলে গো মা
আছ সর্বঘটে, অক্ষপুটে
সাকার আকার নিরাকারা।
তুমি সন্ধ্যা, তুমি গায়ত্রী,
তুমিই জগদ্ধাত্রী গো মা,
তুমি অকূলের ত্রাণকর্ত্রী
সদাশিবের মনোহরা॥