১৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িমধ্যে
চতুর্দশ পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ১৭ই জুন
শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বরে ভক্তসঙ্গে
[তান্ত্রিকভক্ত ও সংসার — নির্লিপ্তেরও ভয়]
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে নিজের ঘরে আহারান্তে কিঞ্চিৎ বিশ্রাম করিয়াছেন। অধর ও মাস্টার আসিয়া প্রণাম করিলেন। একটি তান্ত্রিক ভক্তও আসিয়াছেন। রাখাল, হাজরা, রামলাল প্রভৃতি ঠাকুরের কাছে আজকাল থাকেন। আজ রবিবার, ১৭ই জুন, ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দ। (৪ঠা আষাঢ়) জৈষ্ঠ শুক্লা দ্বাদশী।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — সংসারে হবে না কেন? তবে বড় কঠিন। জনকাদি জ্ঞানলাভ করে সংসারে এসেছিলেন। তবুও ভয়! নিষ্কাম সংসারীরও ভয়। ভৈরবীকে দেখে জনক মুখ হেঁট করেছিল; স্ত্রীদর্শনে সঙ্কোচ হয়েছে! ভৈরবী বললে, জনক! তোমার দেখছি এখনও জ্ঞান হয় নাই; তোমার স্ত্রী-পুরুষ বোধ রয়েছে। কাজলের ঘরে যতই সেয়ানা হও না কেন, একটু না একটু কালো দাগ গায়ে লাগবে।
“দেখেছি, সংসারীভক্ত যখন পূজা করছে গরদ পরে তখন বেশ ভাবটি। এমন কি জলযোগ পর্যন্ত এক ভাব। তারপর নিজ মূর্তি; আবার রজঃ তমঃ।
“সত্ত্বগুণে ভক্তি হয়। কিন্তু ভক্তির সত্ত্ব, ভক্তির রজঃ, ভক্তির তমঃ আছে। ভক্তির সত্ত্ব, বিশুদ্ধ সত্ত্ব — এ-হলে ঈশ্বর ছাড়া আর কিছুতেই মন থাকে না; কেবল দেহটা যাতে রক্ষা হয় ওইটুকু শরীরের উপর মন থাকে।”
[পরমহংস ত্রিগুণাতীত ও কর্মফলের অতীত — পাপ-পুণ্যের অতীত — কেশব সেন ও দল ]
“পরমহংস তিনগুণের অতীত।১ তার ভিতর তিনগুণ আছে আবার নাই। ঠিক বালক, কোন গুণের বশ নয়। তাই ছোট ছোট ছেলেদের পরমহংসরা কাছে আসতে দেয়, তাদের স্বভাব আরোপ করবে বলে।
“পরমহংস সঞ্চয় করতে পারে না। এটা সংসারীদের পক্ষে নয়, তাদের পরিবারদের জন্য সঞ্চয় করতে হয়।”
তান্ত্রিকভক্ত — পরমহংসের কি পাপ-পুণ্য বোধ থাকে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — কেশব সেন ওই কথা জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি বললাম, আরও বললে তোমার দল টল থাকবে না। কেশব বললে, তবে থাক মহাশয়।
“পাপ-পুণ্য কি জানো? পরমহংস অবস্থায় দেখে, তিনিই সুমতি দেন, তিনিই কুমতি দেন। তিতো মিঠে ফল কি নেই? কোন গাছে মিষ্ট ফল, কোন গাছে তিতো বা টক ফল। তিনি মিষ্ট আমগাছও করেছেন, আবার টক আমড়াগাছও করেছেন।”
তান্ত্রিকভক্ত — আজ্ঞা হাঁ, পাহাড়ের উপর দেখা যায় গোলাপের ক্ষেত। যতদূর চক্ষু যায় কেবল গোলাপের ক্ষেত।
শ্রীরামকৃষ্ণ — পরমহংস দেখে, এ-সব তাঁর মায়ার ঐশ্বর্য। সৎ-অসৎ, ভাল-মন্দ, পাপ-পুণ্য। সব বড় দূরের কথা। সে অবস্থায় দল টল থাকে না।
[তান্ত্রিকভক্ত ও কর্মফল, পাপ-পুণ্য — Sin and Responsibility]
তান্ত্রিকভক্ত — তবে কর্মফল আছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — তাও আছে। ভাল কর্ম করলে সুফল, মন্দ কর্ম করলে কুফল; লঙ্কা খেলে ঝাল লাগবে না? এ-সব তাঁর লীলা-খেলা।
তান্ত্রিকভক্ত — আমাদের উপায় কি? কর্মের ফল তো আছে?
শ্রীরামকৃষ্ণ — থাকলেই বা। তাঁর ভক্তের আলাদা কথা।
এই বলিয়া গান গাইতেছেন:
মন রে
কৃষি কাজ জানো
না।
এমন মানব-জমিন রইল
পতিত, আবাদ
করলে ফলত সোনা।
কালীনামে
দাওরে বেড়া,
ফললে তছরূপ
হবে না।
সে যে মুক্তকেশীর
শক্ত বেড়া,
তার কাছেতে যম
ঘেঁসে না ॥
গুরুদত্ত
বীজ রোপণ করে,
ভক্তিবারি
সেঁচে দেনা ৷
একা যদি না পারিস
মন,
রামপ্রসাদকে
সঙ্গে নেনা ॥
আবার গান গাইতেছেন:
শমন আসবার পথ
ঘুচেছে, আমার
মনের সন্দ
ঘুচে গেছে।
ওরে আমার ঘরের
নবদ্বারে
চারি শিব চৌকি
রয়েছে ॥
এক খুঁটিতে ঘর
রয়েছে, তিন
রজ্জুতে
বাঁধা আছে।
সহস্রদল
কমলে শ্রীনাথ
অভয় দিয়ে বসে
আছে ॥
“কাশীতে ব্রাহ্মণই মরুক আর বেশ্যাই মরুক শিব হবে।
“যখন হরিনামে, কালীনামে, রামনামে, চক্ষে জল আসে তখনই সন্ধ্যা-কবচাদির কিছুই প্রয়োজন নাই। কর্মত্যাগ হয়ে যায়। কর্মের ফল তার কাছে যায় না।”
ঠাকুর আবার গান গাইতেছেন:
ভাবিলে
ভাবের উদয় হয়।
যেমন ভাব, তেমনি
লাভ, মূল সে
প্রত্যয়।
কালীপদ
সুধাহ্রদে
চিত্ত যদি রয়
(যদি চিত্ত
ডুবে রয়)।
তবে পূজা-হোম
যাগযজ্ঞ কিছু
নয়।
ঠাকুর আবার গান গাহিতেছেন:
ত্রিসন্ধ্যা
যে বলে কালী,
পূজা সন্ধ্যা
সে কি চায় ৷
সন্ধ্যা
তার
সন্ধ্যানে
ফিরে, কভু
সন্ধি নাহি পায় ॥
গয়া গঙ্গা
প্রভাসাদি
কাশী কাঞ্চী
কেবা চায় ৷
কালী কালী কালী বলে
আমার অজপা যদি
ফুরায় ॥
“তাঁতে মগ্ন হলে আর অসদ্বুদ্ধি, পাপবুদ্ধি থাকে না।”
তান্ত্রিকভক্ত — আপনি যা বলেছেন “বিদ্যার আমি” থাকে।
শ্রীরামকৃষ্ণ — বিদ্যার আমি, ভক্তের আমি। দাস আমি, ভাল আমি থাকে। বজ্জাত আমি চলে যায়। (হাস্য)
তান্ত্রিকভক্ত — আজ্ঞা, আমাদের অনেক সংশয় চলে গেল।
শ্রীরামকৃষ্ণ — আত্মার সাক্ষাৎকার হলে সব সন্দেহ ভঞ্জন হয়।
[তান্ত্রিকভক্ত ও ভক্তির তমঃ — হাবাতের সংশয় — অষ্টসিদ্ধি ]
“ভক্তির তমঃ আন। বল, কি! রাম বলেছি, কালী বলেছি, আমার আবার বন্ধন; আমার আবার কর্মফল।”
ঠাকুর আবার গান গাহিতেছেন:
আমি দুর্গা
দুর্গা বলে মা
যদি মরি
আখেরে এ-দীনে না
তারো কেমনে,
জানা যাবে গো
শংকরী।
নাশি
গো ব্রাহ্মণ,
হত্যা করি
ভ্রূণ,
সুরাপান আদি
বিনাশী নারী;
এ-সব পাতক না ভাবি
তিলেক (ও মা)
ব্রহ্মপদ
নিতে পারি।
শ্রীরামকৃষ্ণ আবার বলিতেছেন — বিশ্বাস! বিশ্বাস! বিশ্বাস! গুরু বলে দিয়েছেন, রামই সব হয়ে রয়েছেন; ‘ওহি রাম ঘট্ ঘট্মে লেটা!’ কুকুর রুটি খেয়ে যাচ্ছে। ভক্ত বলছে, ‘রাম! দাঁড়াও, দাঁড়াও রুটিতে ঘি মেখে দিই’ এমনি গুরুবাক্যে বিশ্বাস।
“হাবাতেগুলোর বিশ্বাস হয় না! সর্বদাই সংশয়! আত্মার সাক্ষাৎকার না হলে সব সংশয় যায় না।২
“শুদ্ধাভক্তি — কোন কামনা থাকবে না, সেই ভক্তি দ্বারা তাঁকে শীঘ্র পাওয়া যায়।
“অণিমাদি সিদ্ধি — এ-সব কামনা। কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, ভাই, অণিমাদি সিদ্ধাই, একটিও থাকলে ঈশ্বরলাভ হয় না; একটু শক্তি বাড়তে পারে।”
“তান্ত্রিকভক্ত — আজ্ঞে, তান্ত্রিক ক্রিয়া আজকাল কেন ফলে না?
শ্রীরামকৃষ্ণ — সর্বাঙ্গীণ হয় না, আর ভক্তিপূর্বক হয় না — তাই ফলে না।
এইবার ঠাকুর কথা সাঙ্গ করিতেছেন। বলিতেছেন, ভক্তিই সার; ঠিক ভক্তের কোন ভয় ভাবনা নাই। মা সব জানে। বিড়াল ইঁদুরকে ধরে একরকম করে, কিন্তু নিজের ছানাকে আর-একরকম করে ধরে।
১
মাঞ্চ
যোঽব্যভিচারেণ
ভক্তিযোগেন
সেবতে।
স গুণান্
সমতীত্যৈতান্
ব্রহ্মভূয়ায়
কল্পতে।।
[গীতা
১৪।২৬]
২ ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়া ... তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে। [মুণ্ডকোপনিষদ্, ২।২।৮]