১৮ দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে এবং ঠনঠনে সিদ্ধেশ্বরী-মন্দিরে গমন
সপ্তম পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ১৪ই ডিসেম্বর
‘প্রয়োজন’ (END OF LIFE) ঈশ্বরকে ভালবাসা
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ঘরে ধুন দেওয়া হইল। ছোট খাটটিতে বসিয়া ঠাকুর ঈশ্বরচিন্তা করিতেছেন। মণি মেঝেতে বসিয়া আছেন। রাখাল, লাটু, রামলাল ইঁহারাও ঘরে আছেন।
ঠাকুর মণিকে বলিতেছেন, কথাটা এই — তাঁকে ভক্তি করা, তাঁকে ভালবাসা। রামলালকে গাইতে বলিলেন। তিনি মধুর কণ্ঠে গাইতেছেন। ঠাকুর এক-একটি গান ধরাইয়া দিতেছেন।
ঠাকুর বলাতে রামলাল প্রথমে শ্রীগৌরাঙ্গের সন্ন্যাস গাইতেছেন:
কি
দেখিলাম রে,
কেশব ভারতীর
কুটিরে,
অপরূপ
জ্যোতিঃ,
শ্রীগৌরাঙ্গ
মূরতি, দুনয়নে
প্রেম বহে
শতধারে।
গৌর
মত্তমাতঙ্গের
প্রায়,
প্রেমাবেশে
নাচে গায়,
কভু
ধরাতে লুটায়,
নয়নজলে ভাসে
রে,
কাঁদে
আর বলে হরি,
স্বর্গমর্ত্য
ভেদ করি, সিংহরবে
রে,
আবার
দন্তে তৃণ লয়ে
কৃতাঞ্জলি
হয়ে,
দাস্য
মুক্তি যাচেন
বারে বারে ॥
মুড়ায়ে
চাঁচর কেশ,
ধরেছেন যোগীর বেশ,
দেখে ভক্তি
প্রেমাবেশ,
প্রাণ কেঁদে
উঠে রে।
জীবের
দুঃখে কাতর
হয়ে,
এলেন সর্বস্ব
ত্যজিয়ে,
প্রেম বিলাতে
রে;
প্রেমদাসের
বাঞ্ছা মনে,
শ্রীচৈতন্যচরণে,
দাস হয়ে বেড়াই
দ্বারে
দ্বারে ॥
রামলাল পরে গাইলেন, শচী কেঁদে বলছেন, ‘নিমাই! কেমন করে তোকে ছেড়ে থাকব?’ ঠাকুর বলিলেন, সেই গানটি গা তো।
(১) — আমি মুক্তি দিতে কাতর নই
(২) — রাধার দেখা কি
পায় সকলে,
রাধার
প্রেম কি পায়
সকলে।
অতি সুদুর্লভ ধন,
না করলে
আরাধন,
সাধন বিনে সে-ধন,
এ-ধনে কি মেলে
তুলারাশিমাসে
তিথি
অমাবস্যা,
স্বাতী
নক্ষত্রে যে
বারি বরিষে,
সে বারি কি বরিষে
বরিষার জলে।
যুবতী
সকলে শিশু লয়ে
কোলে,
আয় চাঁদ বলে ডাকে
বাহু তুলে।
শিশু
তাহে ভুলে, চন্দ্র
কি তায় ভুলে,
গগন
ছেড়ে চাঁদ কি
উদয় হয় ভূতলে।
(৩) — নবনীরদবরণ কিসে গণ্য শ্যামচাঁদ রূপ হেরে।
ঠাকুর রামলালকে আবার বলিতেছেন, সেই গানটি গা — গৌর নিতাই তোমরা দুভাই। রামলালের সঙ্গে ঠাকুরও যোগ দিতেছেন —
গৌর
নিতাই তোমরা
দুভাই, পরম
দয়াল হে প্রভু
(আমি তাই শুনে
এসেছি হে নাথ)
আমি
গিয়েছিলাম
কাশীপুরে,
আমায় কয়ে
দিলেন কাশী
বিশ্বেশ্বরে,
ও সে
পরব্রহ্ম
শচীর ঘরে, (আমি
চিনেছি হে,
পরব্রহ্ম)।
আমি
গিয়েছিলাম
অনেক ঠাঁই,
কিন্তু এমন
দয়াল দেখে নাই।
(তোমাদের মতো)।
তোমরা
ব্রজে ছিলে
কানাই, বলাই,
এখন নদে এসে
হলে গৌর নিতাই।
(সেরূপ লুকায়ে)
ব্রজের খেলা ছিল
দৌড়াদৌড়ি, এখন
নদের খেলা ধূলায়
গড়াগড়ি।
(হরিবোল বলে হে)
(প্রেমে মত্ত
হয়ে)।
ছিল ব্রজের
খেলা উচ্চরোল,
আজ নদের খেলা
কেবল হরিবোল
(ওহে
প্রাণ গৌর)।
তোমার
সকল অঙ্গ গেছে
ঢাকা, কেবল
আছে দুটি নয়ন বাঁকা।
(ওহে দয়াল গৌর)।
তোমার
পতিতপাবন নাম
শুনে, বড় ভরসা
পেয়েছি মনে।
(ওহে
পতিতপাবন)।
বড় আশা করে এলাম
ধেয়ে, আমায়
রাখ চরণ ছায়া
দিয়ে।
(ওহে
দয়াল গৌর)।
জগাই
মাধাই তরে
গেছে, প্রভু
সেই ভরসা আমার
আছে।
(ওহে অধমতারণ)।
তোমরা নাকি
আচণ্ডালে দাও
কোল, কোল দিয়ে
বল হরিবোল!
(ওহে পরম করুণ)
(ও কাঙালের
ঠাকুর)।
[ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্তদের গোপনে সাধন ]
নহবতখানার উপরের ঘরে মণি একাকী বসিয়া আছেন। অনেক রাত্রি হইয়াছে। আজ অগ্রহায়ণ পূর্ণিমা। আকাশ, গঙ্গা, কালীবাড়ি, মন্দিরশীর্ষ, উদ্যানপথ, পঞ্চবটী চাঁদের আলোতে ভাসিয়াছে! মণি একাকী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে চিন্তা করিতেছেন।
রাত প্রায় তিনটা হইল, তিনি উঠিলেন। উত্তরাস্য হইয়া পঞ্চবটীর অভিমুখে যাইতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পঞ্চবটীর কথা বলিয়াছেন। আর নহবতখানা ভাল লাগিতেছে না। তিনি পঞ্চবটীর ঘরে থাকিবেন, স্থির করিলেন।
চতুর্দিক নীরব। রাত এগারটার সময় জোয়ার আসিয়াছে। এক-একবার জলের শব্দ শুনা যাইতেছে। তিনি পঞ্চবটীর দিকে অগ্রসর হইতেছেন! — দূর হইতে একটি শব্দ শুনিতে পাইলেন। কে যেন পঞ্চবটীর বৃক্ষমণ্ডপের ভিতর হইতে আর্তনাদ করিয়া ডাকিতেছেন, কোথায় দাদা মধুসূদন!
আজ পূর্ণিমা। চতুর্দিকে বটবৃক্ষের শাখাপ্রশাখার মধ্য দিয়া চাঁদের আলো পাটিয়ে পড়িতেছে।
আরও অগ্রসর হইলেন। একটু দূর হইতে দেখিলেন পঞ্চবটীরমধ্যে ঠাকুরের একটি ভক্ত বসিয়া আছেন! তিনিই নির্জনে একাকী ডাকিতেছেন, কোথায় দাদা মধুসূদন! মণি নিঃশব্দে দেখিতেছেন।