১৯ গুরুরূপী শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে
প্রথম পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ২৩শে ডিসেম্বর
সমাধিমন্দিরে — ঈশ্বরদর্শন ও ঠাকুরের পরমহংস অবস্থা
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁহার ঘরের দক্ষিণ-পূর্বের বারান্দায় রাখাল, লাটু, মণি, হরিশ প্রভৃতি ভক্তসঙ্গে বসিয়া আছেন। বেলা নয়টা হবে। রবিবার, অগ্রহায়ণ কৃষ্ণা নবমী, ২৩শে ডিসেম্বর, ১৮৮৩।
মণির গুরুগৃহে বাসের আজ দশম দিবস।
শ্রীযুত মনোমোহন কোন্নগর হইতে সকাল বেলা আসিয়াছেন। ঠাকুরকে দর্শন করিয়া ও কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম করিয়া আবার কলিকাতায় যাইবেন। হাজরাও ঠাকুরের কাছে বসিয়া আছেন। নীলকণ্ঠের দেশের একজন বৈষ্ণব ঠাকুরকে গান শুনাইতেছেন। বৈষ্ণব প্রথমে নীলকণ্ঠের গান গাইলেন:
শ্রীগৌরাঙ্গসুন্দর
নব-নটবর
তপতকাঞ্চন
কায়।
করে স্বরূপ
বিভিন্ন,
লুকাইয়ে
চিহ্ন,
অবতীর্ণ নদীয়ায়।
কলিঘোর
অন্ধকার
বিনাশিতে,
উন্নত
উজ্জ্বল রস
প্রকাশিতে,
তিন
বাঞ্ছা তিন
বস্তু
আস্বাদিতে,
এসেছ তিনেরি
দায়; —
সে তিন পরশে,
বিরস-হরষে,
দরশে জগৎ
মাতায় ॥
নীলাব্জ
হেমাব্জে
করিয়ে আবৃত,
হ্লাদিনীর পূরাও
দেহভেদগত; —
অধিরূঢ়
মহাভাবে
বিভাবিত,
সাত্ত্বিকাদি
মিলে যায়;
সে ভাব
আস্বাদনের
জন্য, কান্দেন
অরণ্যে,
প্রেমের
বন্যে ভেসে
যায় ॥
নবীন
সন্ন্যাসী,
সুতীর্থ অন্বেষী,
কভু নীলাচলে
কভু যান কাশী;
অযাচক
দেন প্রেম
রাশি রাশি,
নাহি জাতিভেদ
তায়;
দ্বিজ
নীলকণ্ঠে ভণে,
এই বাঞ্ছা
মনে, কবে
বিকাব গৌরের
পায়।
পরের গানটি মানসপূজা সম্বন্ধে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (হাজরার প্রতি) — এ-গান (মানসপূজা) কি একরকম লাগল।
হাজরা — এ সাধকের নয়, — জ্ঞান দীপ, জ্ঞান প্রতিমা!
[পঞ্চবটীতে তোতাপুরীর ক্রন্দন — পদ্মলোচনের ক্রন্দন ]
শ্রীরামকৃষ্ণ — আমার কেমন কেমন বোধ হল!
“আগেকার সব গান ঠিক ঠিক। পঞ্চবটীতে, ন্যাংটার কাছে আমি গান গেয়েছিলাম, — ‘জীব সাজ সমরে, রণবেশে কাল প্রবেশে তোর ঘরে।’ আর-একটা গান — ‘দোষ কারু নয় গো মা, আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা।’
“ন্যাংটা অত জ্ঞানী, — মানে না বুঝেই কাঁদতে লাগল।
“এ-সব গানে কেমন ঠিক ঠিক কথা —
“ভাব শ্রীকান্ত নরকান্তকারীরে নিতান্ত কৃতান্ত ভয়ান্ত হবি!
“পদ্মলোচন আমার মুখে রামপ্রসাদের গান শুনে কাঁদতে লাগল। দেখ, অত বড় পণ্ডিত!”
[God-vision — One and
Many: Unity in Diversity —
ঠাকুর
শ্রীরামকৃষ্ণ
ও বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ ]
আহারের পর ঠাকুর একটু বিশ্রাম করিয়াছেন। মেঝেতে মণি বসিয়া আছেন। নহবতের রোশনচৌকি বাজনা শুনিতে শুনিতে ঠাকুর আনন্দ করিতেছেন।
শ্রবণের পর মণিকে বুঝাইতেছেন, ব্রহ্মই জীবজগৎ হয়ে আছেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ (মণির প্রতি) — কেউ বললে, অমুক স্থানে হরিনাম নাই। বলবামাত্রই দেখলাম, তিনিই সব জীব১ হয়ে আছেন। যেন অসংখ্য জলের ভুড়ভুড়ি — জলের বিম্ব! আবার দেখছি যেন অসংখ্য বড়ি বড়ি!
“ও-দেশ থেকে বর্ধমানে আসতে আসতে দৌড়ে একবার মাঠের পানে গেলাম, — বলি, দেখি, এখানে জীবরা কেমন করে খায়, থাকে! গিয়ে দেখি মাঠে পিঁপড়ে চলেছে! সব স্থানই চৈতন্যময়!”
হাজরা ঘরে প্রবেশ করিয়া মেঝেতে বসিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ — নানা ফুল — পাপড়ি থাক থাক২ তাও দেখেছি! — ছোট বিম্ব, বড় বিম্ব!
এই সকল ঈশ্বরীয়রূপদর্শন-কথা বলিতে বলিতে ঠাকুর সমাধিস্থ হইতেছেন। বলিতেছেন, আমি হয়েছি! আমি এসেছি!
এই কথা বলিয়াই একেবারে সমাধিস্থ হইলেন। সমস্ত স্থির! অনেকক্ষণ সম্ভোগের পর বাহিরের একটু হুঁশ আসিতেছে।
এইবার বালকের ন্যায় হাসিতেছেন। হেসে হেসে ঘরের মধ্যে পাদচারণ করিতেছেন।
[ক্ষোভ, বাসনা গেলেই পরমহংস অবস্থা — সাধনকালে বটতলায় পরমহংসদর্শন-কথা ]
অদ্ভুতদর্শনের পর চক্ষু হইতে যেরূপ আনন্দ-জ্যোতিঃ বাহির হয়, সেইরূপ ঠাকুরের চক্ষের ভাব হইল। মুখে হাস্য। শূন্যদৃষ্টি।
ঠাকুর পায়চারি করিতে করিতে বলিতেছেন —
“বটতলায় পরমহংস দেখলম — এইরকম হেসে চলছিল! — সেই স্বরূপ কি আমার হল!”
এইরূপ পাদচারণের পর ঠাকুর ছোট খাটটিতে গিয়া বসিয়াছেন ও জগন্মাতার সহিত কথা কহিতেছেন।
ঠাকুর বলিতেছেন, “যাক আমি জানতেও চাই না! — মা, তোমার পাদপদ্মে যেন শুদ্ধাভক্তি থাকে।”
(মণির প্রতি) — ক্ষোভ বাসনা গেলেই এই অবস্থা!
আবার মাকে বলিতেছেন, “মা! পূজা উঠিয়েছ; — সব বাসনা যেন যায় না! পরমহংস তো বালক — বালকের মা চাই না? তাই তুমি মা, আমি ছেলে। মার ছেলে মাকে ছেড়ে কেমন করে থাকে!”
ঠাকুর এরূপ স্বরে মার সঙ্গে কথা বলিতেছেন যে, পাষাণ পর্যন্ত বিগলিত হইয়া যায়। আবার মাকে বলিতেছেন, “শুধু অদ্বৈতজ্ঞান! হ্যাক্ থু!! যতক্ষণ ‘আমি’ রেখেছ ততক্ষণ তুমি! পরমহংস তো বালক, বালকের মা চাই না?”
মণি অবাক্ হইয়া ঠাকুরের এই দেবদুর্লভ অবস্থা দেখিতেছেন। ভাবিতেছেন ঠাকুর অহেতুক কৃপাসিন্ধু। তাঁহারই বিশ্বাসের জন্য — তাঁহারই চৈতন্যের জন্য — আর জীবশিক্ষার জন্য গুরুরূপী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের এই পরমহংস অবস্থা।
মণি আরও ভাবিতেছেন — “ঠাকুর বলেন, অদ্বৈত — চৈতন্য — নিত্যানন্দ। অদ্বৈতজ্ঞান হলে চৈতন্য হয়, — তবেই নিত্যনন্দ হয়। ঠাকুরের শুধু অদ্বৈতজ্ঞান নয়, — নিত্যানন্দের অবস্থা। জগন্মাতার প্রেমানন্দে সর্বদাই বিভোর, — মাতোয়ারা!”
হাজরা ঠাকুরের এই অবস্থা হঠাৎ দেখিয়া হাতজোড় করিয়া মাঝে মাঝে বলিতে লাগিলেন — “ধন্য! ধন্য!”
শ্রীরামকৃষ্ণ হাজরাকে বলিতেছেন, “তোমার বিশ্বাস কই? তবে তুমি এখানে আছ যেমন জটিলে-কুটিলে — লীলা পোষ্টাই জন্য।”
বৈকাল হইয়াছে। মণি একাকী দেবালয়ে নির্জনে বেড়াইতেছেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের এই অদ্ভুত অবস্থা ভাবিতেছেন। আর ভাবিতেছেন, ঠাকুর কেন বলিলেন, “ক্ষোভ বাসনা গেলেই এই অবস্থা।” এই গুরুরূপী ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কে? স্বয়ং ভগবান কি আমাদের জন্য দেহধারণ করে এসেছেন? ঠাকুর বলেন, ঈশ্বরকোটি — অবতারাদি — না হলে জড়সমাধি (নির্বিকল্পসমাধি) হতে নেমে আসতে পারে না।
১ সর্বভূতস্থমাত্মানং সর্বভূতানি চাত্মানি
২
ঈক্ষতে
যোগযুক্তাত্মা
সর্বত্র
সমদর্শনঃ ॥
[গীতা, ৬।২৯]
আত্মনি চৈবং
বিচিত্রাশ্চহি।
[বেদান্তসূত্র,
২।১।২৮]