২০ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে
দশম পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ২রা ফেব্রুয়ারি
মহিমাচরণের শাস্ত্রপাঠ শ্রবণ ও ঠাকুরের সমাধি
কথা কহিতে কহিতে রাত আটটা হইয়াছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মহিমাচরণকে শাস্ত্র হইতে কিছু স্তবাদি শুনাইতে বলিলেন। মহিমাচরণ একখানি বই লইয়া উত্তর গীতার প্রথমেই পরব্রহ্মসম্বন্ধীয় যে শ্লোক তাহা শুনাইতেছেন —
“যদেকং
নিষ্কলং
ব্রহ্ম
ব্যোমাতীতং
নিরঞ্জনম্।
অপ্রতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ং
বিনাশোৎপত্তিবর্জিতম্
॥”
ক্রমে তৃতীয় অধ্যায়ের ৭ম শ্লোক পড়িতেছেন —
“অগ্নির্দেবো
দ্বিজাতীনাং
মুনীনাং হৃদি
দৈবতম্।
প্রতিমা
স্বল্পবুদ্ধীনাং
সর্বত্র
সমদর্শিনাম্
॥”
অর্থাৎ ব্রাহ্মদিগের দেবতা অগ্নি, মুনিদিগের দেবতা হৃদয়মধ্যে — স্বল্পবুদ্ধি মনুষ্যদের প্রতিমাই দেবতা, আর সমদর্শী মহাযোগীদিগের দেবতা সর্বত্রই আছেন।
“সর্বত্র সমদর্শিনাম” — এই কথা উচ্চারণ করিবামাত্র ঠাকুর হঠাৎ আসন ত্যাগ করিয়া দণ্ডায়মান হইয়া সমাধিস্থ হইলেন। হাতে সেই বাড় ও ব্যাণ্ডেজ বাঁধা। ভক্তেরা সকলেই অবাক্ — এই সমদর্শী মহাযোগীর অবস্থা নিরীক্ষণ করিতেছেন।
অনেকক্ষণ এইরূপে দাঁড়াইয়া প্রকৃতিস্থ হইলেন ও আবার আসন গ্রহণ করিলেন। মহিমাচরণকে এইবার সেই হরিভক্তির শ্লোক আবৃত্তি করিতে বলিলেন। মহিমা নারদপঞ্চরাত্র হইতে আবৃত্তি করিতেছেন —
অন্তর্বহির্যদিহরিস্তপসা
ততঃ কিম্।
নান্তর্বহির্যদিহরিস্তপসা
ততঃ কিম্ ॥
আরাধিতো যদি
হরিস্তপসা
ততঃ কিম্।
নারাধিতো
যদি
হরিস্তপসা
ততঃ কিম্ ॥
বিরম বিরম
ব্রহ্মন্
কিং তপস্যাসু
বৎস।
ব্রজ
ব্রজ দ্বিজ
শীঘ্রং
শঙ্করং জ্ঞানসিন্ধুম্
॥
লভ লভ
হরিভক্তিং
বৈষ্ণবোক্তাং
সুপক্কাম্।
ভবনিগড়নিবন্ধচ্ছেদনীং
কর্তরীঞ্চ ॥
শ্রীরামকৃষ্ণ — আহা! আহা!
[ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ড — তুমিই চিদানন্দ — নাহং নাহং ]
শ্লোকগুলির আবৃত্তি শুনিয়া ঠাকুর আবার ভাবাবিষ্ট হইতেছিলেন। কষ্টে ভাব সংবরণ করিলেন। এইবার যতিপঞ্চক পাঠ হইতেছে —
যস্যামিদং
কল্পিতমিন্দ্রজালং,
চরাচরং ভাতি
মনোবিলাসম্।
সচ্চিৎসুখৈকং
জগদাত্মরূপং,
সা কাশিকাহং
নিজবোধরূপম্
॥
“সা কাশিকাহং নিজবোধরূপম্” — এই কথা শুনিয়া ঠাকুর সহাস্যে বলিতেছেন, “যা আছে ভাণ্ডে তাই আছে ব্রহ্মাণ্ডে।”
এইবার পাঠ হইতেছে নির্বাণষট্কম্ —
ওঁ
মনোবুদ্ধ্যহঙ্কারচিত্তানি
নাহং
ন চ
শ্রোত্রজিহ্বে
ন চ
ঘ্রাণনেত্রে।
ন চ ব্যোম
ভূমির্ন তেজো
ন বায়ু —
শ্চিদানন্দরূপঃ
শিবোঽহং শিবোঽহম্ ॥
যতবার মহিমাচরণ বলিতেছেন — চিদানন্দরূপঃ শিবোঽহং শিবোঽহম্, ততবারই ঠাকুর সহাস্যে বলিতেছেন —
“নাহং! নাহং — তুমি তুমি চিদানন্দ।”
মহিমাচরণ জীবন্মুক্তি গীতা থেকে কিছু পড়িয়া ষট্চক্রবর্ণনা পড়িতেছেন। তিনি নিজে কাশীতে যোগীর যোগাবস্থায় মৃত্যু দেখিয়াছিলেন, বলিলেন।
এইবার ভূচরী ও খেচরী মুদ্রার বর্ণনা করিতেছেন, ও সাম্ভবী বিদ্যার।
সাম্ভবী; — যেখানে সেখানে যায়, কোন উদ্দেশ্য নাই।
[পূর্বকথা — সাধুদের কাছে ঠাকুরের রামগীতাপাঠ শ্রবণ ]
মহিমা — রামগীতায় বেশ বেশ কথা আছে।
শ্রীরামকৃষ্ণ (সহাস্যে) —তুমি রামগীতা রামগীতা কচ্ছো, — তবে তুমি ঘোর বেদান্তী! সাধুরা কত পড়ত এখানে।
মহিমাচরণ প্রণব শব্দ কিরূপ তাই পড়িতেছেন — “তৈলধারামবিচ্ছিন্নম্ দীর্ঘঘন্টানিনাদবৎ”! আবার সমাধির লক্ষণ বলিতেছেন —
“ঊর্ধ্বপূর্ণমধঃপূর্ণং
মধ্যপূর্ণং
যদাত্মকম্।
সর্বপূর্ণং
স আত্মেতি
সমাধিস্থস্য
লক্ষণম্ ॥”
অধর, মহিমাচরণ ক্রমে প্রণাম করিয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন।