২৮ শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ভক্তসঙ্গে

সপ্তম পরিচ্ছেদ

১৮৮৪, ১৪ই সেপ্টেম্বর


নারাণের জন্য ঠাকুরের ভাবনা — কোন্নগরের ভক্তগণ — শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি ও নরেন্দ্রের গান

ঠাকুরের ঘরে অনেক ভক্ত সমাগত হইয়াছেন। কোন্নগরের ভক্তদের মধ্যে একজন সাধক নূতন আসিয়াছেন — বয়ঃক্রম পঞ্চাশের উপর। দেখিলে বোধ হয়, ভিতরে খুব পাণ্ডিত্যাভিমান আছে। কথা কহিতে কহিতে তিনি বলিতেছেন, “সমুদ্র মন্থনের আগে কি চন্দ্র ছিল না? এ-সব মীমাংসা কে করবে?”

মাস্টার (সহাস্যে) — ‘ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন মুণ্ডমালা কোথায় পেলি?’

সাধক (বিরক্ত হইয়া) — ও আলাদা কথা।

ঘরের মধ্যে দাঁড়াইয়া ঠাকুর মাস্টারকে হঠাৎ বলিতেছেন, “সে এসেছিল — নারাণ।”

নরেন্দ্র বারান্দায় হাজরা প্রভৃতির সহিত কথা কহিতেছেন — বিচারের শব্দ ঠাকুরের ঘর হইতে শুনা যাইতেছে।

শ্রীরামকৃষ্ণ — খুব বকতে পারে! এখন বাড়ির ভাবনায় বড় পড়েছে।

মাস্টার — আজ্ঞা, হাঁ।

শ্রীরামকৃষ্ণ — বিপদকে সম্পদজ্ঞান করবে বলেছিল কিনা। কি?

মাস্টার — আজ্ঞা, মনের বলটা খুব আছে।

বড়কালী — কোন্‌টা কম? [ঠাকুর নিজের আসনে বসিয়াছেন।]

কোন্নগরের একটি ভক্ত ঠাকুরকে বলিতেছেন — মহাশয়, ইনি (সাধক) আপনাকে দেখতে এসেছেন — এঁর কি কি জিজ্ঞাস্য আছে।

সাধক দেহ ও মস্তক উন্নত করিয়া বসিয়া আছেন।

সাধক — মহাশয়, উপায় কি?

[ঈশ্বরদর্শনের উপায়, গুরুবাক্যে বিশ্বাস — শাস্ত্রের ধারণা কখন ]

শ্রীরামকৃষ্ণ — গুরুবাক্যে বিশ্বাস। তাঁর বাক্য ধরে ধরে গেলে ভগবানকে লাভ করা যায়। যেমন সুতোর খি ধরে ধরে গেলে বস্তুলাভ হয়।

সাধক — তাঁকে কি দর্শন করা যায়?

শ্রীরামকৃষ্ণ — তিনি বিষয়বুদ্ধির অগোচর। কামিনী-কাঞ্চনে আসক্তির লেশ থাকলে তাঁকে পাওয়া যায় না। কিন্তু শুদ্ধমন, শুদ্ধবুদ্ধির গোচর — যে মনে, যে বুদ্ধিতে, আসক্তির লেশমাত্র নাই। শুদ্ধমন, শুদ্ধবুদ্ধি, আর শুদ্ধ আত্মা — একই জিনিস।

সাধক — কিন্তু শাস্ত্রে বলছে, ‘যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ।’ — তিনি বাক্য-মনের অগোচর।

শ্রীরামকৃষ্ণ — ও থাক্‌ থাক্‌। সাধন না করলে শাস্ত্রের মানে বোঝা যায় না। সিদ্ধি সিদ্ধি বললে কি হবে? পণ্ডিতেরা শ্লোক সব ফড়র ফড়র করে বলে। কিন্তু তাতে কি হবে? সিদ্ধি গায় মাখলেও নেশা হয় না, খেতে হয়।

“শুধু বললে কি হবে ‘দুধে আছে মাখন’, ‘দুধে আছে মাখন’? দুধকে দই পেতে মন্থন কর, তবে তো হবে!”

সাধক — মাখন তোলা — ও-সব তো শাস্ত্রের কথা।

শ্রীরামকৃষ্ণ — শাস্ত্রের কথা বললে বা শুনলে কি হবে? ধারণা করা চাই। পাঁজিতে লিখেছে বিশ আড়া জল। পাঁজি টিপলে একটুও পড়ে না।

সাধক — মাখন তোলা — আপনি তুলেছেন?

শ্রীরামকৃষ্ণ — আমি কি করেছি আর না করেছি — সে কথা থাক। আর এ-সব কথা বোঝানো বড় শক্ত। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে — ঘি কিরকম খেতে। তার উত্তর — কেমন ঘি, না যেমন ঘি!

“এ-সব জানতে গেলে সাধুসঙ্গ দরকার। কোন্‌টা কফের নাড়ী, কোন্‌টা পিত্তের নাড়ী, কোন্‌টা বায়ুর নাড়ী — এটা জানতে গেলে বৈদ্যের সঙ্গে থাকা দরকার।”

সাধক — কেউ কেউ অন্যের সঙ্গে থাকতে বিরক্ত হয়।

শ্রীরামকৃষ্ণ — সে জ্ঞানের পর — ভগবানলাভের পর — আগে সাধুসঙ্গ চাই না?

সাধক চুপ করিয়া আছেন।

সাধক (কিয়ৎক্ষণ পরে, গরম হইয়া) — আপনি তাঁকে যদি জানতে পেরেছেন বলুন — প্রত্যক্ষেই হোক আর অনুভবেই হোক। ইচ্ছা হয় পারেন বলুন, না হয় না বলুন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (ঈষৎ হাসিতে হাসিতে) — কি বলবো! কেবল আভাস বলা যায়।

সাধক — তাই বলুন।

নরেন্দ্র গান গাহিবেন। নরেন্দ্র বলিতেছেন, পাখোয়াজটা আনলে না।

ছোট গোপাল — মহিম (মহিমাচরণ) বাবুর আছে —

শ্রীরামকৃষ্ণ — না, ওর জিনিস এনে কাজ নাই।

আগে কোন্নগরের একটি ভক্ত কালোয়াতি গান গাহিতেছেন।

গানের সময় ঠাকুর সাধকের অবস্থা এক-একবার দেখিতেছেন। গায়ক নরেন্দ্রের সহিত গানবাজনা সম্বন্ধে ঘোরতর তর্ক করিতেছেন।

সাধক গায়ককে বলছেন, তুমিও তো বাপু কম নও। এ-সব তর্কে কি দরকার!

আর-একজন তর্কে যোগ দিয়াছিলেন — ঠাকুর সাধককে বলিতেছেন, “আপনি এঁকে কিছু বকলেন না?”

শ্রীরামকৃষ্ণ কোন্নগরের ভক্তদের বলছেন, “কই আপনাদের সঙ্গেও এর ভাল বনে না দেখছি।”

নরেন্দ্র গান গাহিতেছেন:

যাবে কি হে দিন আমার বিফলে চলিয়ে,
আছি নাথ দিবানিশি আশাপথ নিরখিয়ে।

সাধক গান শুনিতে শুনিতে ধ্যানস্থ হইয়াছেন। ঠাকুরের তক্তপোশের উত্তরে দক্ষিণাস্য হইয়া বসিয়া আছেন। বেলা ৩টা-৪টা হইবে। পশ্চিমের রোদ্র আসিয়া তাঁহার গায়ে পড়িয়াছে। ঠাকুর তাড়াতাড়ি একটি ছাতি লইয়া তাহার পশ্চিমদিকে রাখিলেন। যাহাতে রৌদ্র সাধকের গায়ে না লাগে।

নরেন্দ্র গান গাহিতেছেন:

মলিন পঙ্কিল মনে কেমনে ডাকিব তোমায়।
পারে কি তৃণ পশিতে জ্বলন্ত অনল যথায় ॥
তুমি পুণ্যের আধার, জ্বলন্ত অনলসম।
আমি পাপী তৃণসম, কেমনে পূজিব তোমায় ॥
শুনি তব নামের গুণে, তরে মহাপাপী জনে।
লইতে পবিত্র নাম কাঁপে হে মম হৃদয় ॥
অভ্যস্ত পাপের সেবায়, জীবন চলিয়া যায়।
কেমনে করিব আমি পবিত্র পথ আশ্রয় ॥
এ পাতকী নরাধমে, তার যদি দয়াল নামে।
বল করে কেশে ধরে, দাও চরণে আশ্রয় ॥