৩৪ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ
দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে লাটু, মাস্টার, মণিলাল, মুখুজ্জে প্রভৃতি
ভক্ত সঙ্গে ও কলুটোলায় কীর্তনানন্দে
ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ
১৮৮৪, ৪ঠা অক্টোবর
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কলুটোলায় শ্রীযুক্ত নবীন সেনের বাটীতে ব্রাহ্মভক্তসঙ্গে কীর্তনানন্দে
আজ শনিবার কোজাগর পূর্ণিমা (চন্দ্রগ্রহণ)। শ্রীযুক্ত কেশব সেনের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নবীন সেনের কলুটোলার বাটীতে ঠাকুর আসিয়াছেন। ৪ঠা অক্টোবর ১৮৮৪ খ্রীষ্টাব্দ; ১৯শে আশ্বিন, ১২৯১ সাল।
গত বৃহস্পতিবারে কেশবের মা ঠাকুরকে নিমন্ত্রণ করিয়া অনেক করিয়া যাইতে বলিয়া গিয়াছিলেন।
বাহিরের উপরের ঘরে গিয়া ঠাকুর বসিলেন। নন্দলাল প্রভৃতি কেশবের ভ্রাতুষ্পুত্রগণ, কেশবের মাতা ও তাঁহাদের আত্মীয় বন্ধুগণ ঠাকুরকে খুব যত্ন করিতেছেন। উপরের ঘরেই সংকীর্তন হইল। কলুটোলার সেনেদের অনেক মেয়েরাও আসিয়াছেন।
ঠাকুরের সঙ্গে বাবুরাম, কিশোরী, আরও দু-একটি ভক্ত। মাস্টারও আসিয়াছেন।
তিনি নিচে বসিয়া ঠাকুরের মধুর সংকীর্তন শুনিতেছেন।
ঠাকুর ব্রাহ্মভক্তদের বলিতেছেন, — সংসার অনিত্য; আর সর্বদা মৃত্যু স্ম রণ করা উচিত। ঠাকুর গান গাইতেছেন:
ভেবে দেখ মন কেউ
কারু নয়, মিছে ভ্রম
ভূমণ্ডলে।
ভুল না দক্ষিণাকালী
বদ্ধ হয়ে মায়াজালে
॥
দিন দুই-তিনের
জন্য ভবে কর্তা
বলে সবাই মানে।
সেই কর্তারে দেবে
ফেলে, কালাকালের
কর্তা এলে ॥
যার জন্য মর ভেবে,
সে কি তোমার সঙ্গে
যাবে।
সেই প্রেয়সী দিবে
ছড়া অমঙ্গল হবে
বলে ॥
ঠাকুর বলিতেছেন — ডুব দাও — উপরে ভাসলে কি হবে? দিন কতক নির্জনে সব ছেড়ে, ষোল আনা মন দিয়ে, তাঁকে ডাকো।
ঠাকুর গান গাইতেছেন:
ডুব্ ডুব্ ডুব্
রূপসাগরে আমার মন।
তলাতল পাতাল খুঁজলে
পাবি রে প্রেম
রত্নধন ॥
ঠাকুর ব্রাহ্মভক্তদের, “তুমি সর্বস্ব আমার।” এই গানটি গাইতে বলিতেছেন।
তুমি সর্বস্ব
আমার (হে নাথ)
প্রাণাধার
সারাৎসার।
নাহি তোমা বিনে,
কেহ ত্রিভুবনে,
আপনার বলিবার।
ঠাকুর নিজে গাইতেছেন:
যশোদা নাচাতো
গো মা বলে নীলমণি।
সেরূপ লুকালে
কোথা করালবদনী ॥
(একবার নাচ গো
শ্যামা) (অসি ফেলে
বাঁশী লয়ে)
(মুণ্ডমালা ফেলে
বনমালা লয়ে) (তোর
শিব বলরাম হোক)
(তেমনি তেমনি করে
নাচ গো শ্যামা)
(যেরূপে ব্রজমাঝে
নেচেছিলি)
(একবার বাজা গো
মা, তোর মোহন বেণু)
(যে বেণুরবে গোপীর
মন ভুলাতিস্)
(যে বেণুরবে ধেনু
ফিরাতিস্)
(যে বেণুরবে যমুনা
উজান বয়)।
গগনে বেলা বাড়িত,
রানীর মন ব্যাকুল
হতো,
বলে ধর ধর ধর, ধর রে
গোপাল, ক্ষীর সর
নবনী;
এলায়ে চাঁচর কেশ
রানী বেঁধে দিত
বেণী।
শ্রীদামের সঙ্গে,
নাচিতে ত্রিভঙ্গ,
আবার তাথৈয়া তাথৈয়া,
তাতা থৈয়া থৈয়া,
বাজত নূপুরধ্বনি;
শুনতে পেয়ে আসত
ধেয়ে যত ব্রজের
রমণী (গো মা!) — ।
এই গান শুনিয়া কেশব ওই সুরের একটি গান বাঁধাইয়াছিলেন। ব্রাহ্মভক্তেরা খোল-করতাল সংযোগে সেই গান গাইতেছেন:
কত ভালবাস গো মা
মানব সন্তানে,
মনে হলে প্রেমধারা
বহে দুনয়নে।
তাঁহারা আবার মার নাম করিতেছেন:
(১)
—
অন্তরে
জাগিছ গো মা
অন্তরযামিনী,
কোলে করে আছ মোরে
দিবস যামিনী।
(২)
—
কেন রে
মন ভাবিস এত দীন
হীন কাঙালের মতো,
আমার মা
ব্রহ্মাণ্ডেশ্বরী
সিদ্ধেশ্বরী
ক্ষেমঙ্করী।
ঠাকুর এইবার হরিনাম ও শ্রীগৌরাঙ্গের নাম করিতেছেন ও ব্রাহ্মভক্তদের সহিত নাচিতেছেন।
(১) — মধুর হরিনাম নসে রে, জীব যদি সুখে থাকবি।
(২)
—
গৌরপ্রেমের
ঢেউ লেগেছে গায়।
হুঙ্কারে
পাষণ্ড-দলন
এ-ব্রহ্মাণ্ড
তলিয়ে যায় ॥
(৩) — ব্রজে যাই কাঙ্গালবেশে কৌপিন দাও হে ভারতী।
(৪) — গৌর নিতাই তোমরা দুভাই, পরম দয়াল হে প্রভু।
(৫) — হরি বলে আমার গৌর নাচে।
(৬)
—
কে হরিবোল
হরিবোল বলিয়ে যায়।
যারে মাধাই জেনে
আয়।
(আমার গৌর যায় কি
নিতাই যায় রে)
(যাদের সোনার নূপুর
রাঙা পায়)
(যাদের নেড়া মাথা
ছেঁড়া কাঁথা রে,)
(যেন দেখি পাগলের
প্রায়)।
ব্রাহ্মভক্তেরা আবার গাইতেছেন:
কত দিনে হবে সে
প্রেম সঞ্চার।
হয়ে পূর্ণকাম বলব
হরিনাম, নয়নে
বহিবে
প্রেম-অশ্রুধার ॥
ঠাকুর উচ্চ সংকীর্তন করিয়া গাহিতেছেন ও নাচিতেছেন:
(১)
—
যাদের হরি
বলতে নয়ন ঝরে,
তারা, দুভাই এসেছে রে!
(যারা মার খে য়ে প্রেম
যাচে, তারা) (যারা আপনি
কেঁদে জগৎ কাঁদায়)।
(২) — নদে টলমল টলমল করে ওই গৌর প্রেমের হিল্লোলে রে!
ঠাকুর মার নাম করিতেছেন:
গো আনন্দময়ী হয়ে আমায় নিরানন্দ করো না।
ব্রাহ্মভক্তেরা তাঁহাদের দুইটি গান গাহিতেছেন:
(১) — আমায় দে মা পাগল করে।
(২) — চিদাকাশে হল পূর্ণ প্রেম চন্দ্রোদয় হে।