১২ শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে দক্ষিণেশ্বর-মন্দিরে ও বলরাম-মন্দিরে
সপ্তদশ পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ৮ই এপ্রিল
শ্রীরামলাল প্রভৃতির গান ও শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধি
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গান গাহিতে বলিলেন। রামলাল ও কালীবাড়ির একটি ব্রাহ্মণ কর্মচারী গাহিতেছেন। সঙ্গতের মধ্যে একটি বাঁয়ার ঠেকা —
(১)
—
হৃদি-বৃন্দাবনে
বাস যদি কর
কমলাপতি ৷
ওহে
ভক্তিপ্রিয়,
আমার ভক্তি
হবে রাধাসতী ॥
মুক্তি
কামনা আমারি,
হবে বৃন্দে
গোপনারী,
দেহ হবে নন্দের
পুরী, স্নেহ
হবে মা যশোমতী ॥
আমার ধর ধর
জনার্দন,
পাপভার
গোবর্ধন,
কামাদি
ছয় কংসচরে
ধ্বংস কর
সম্প্রতি ॥
বাজায়ে
কৃপা বাঁশরি,
মনধেনুকে বশ
করি,
তিষ্ঠ
হৃদিগোষ্ঠে
পুরাও ইষ্ট এই
মিনতি ॥
আমার
প্রেমরূপ
যমুনাকুলে,
আশাবংশীবটমূলে,
স্বদাস
ভেবে সদয়ভাবে,
সতত কর বসতি ॥
যদি বল
রাখাল-প্রেমে,
বন্দী থাকি
ব্রজধামে,
জ্ঞানহীন
রাখাল তোমার,
দাস হবে হে
দাশরথি ॥
(২)
—
নবনীরদবরণ
কিসে গণ্য
শ্যামচাঁদ
রূপ হেরে,
করেতে
বাঁশি অধরে
হাসি, রূপে
ভুবন আলো রে ॥
জড়িত
পীতবসন, তড়িত
জিনি ঝলমল,
আন্দোলিত
চরণাবধি
হৃদিসরোজে
বনমাল,
নিতে
যুবতী-জাতিকুল,
আলো করে
যমুনাকুল,
নন্দকুল চন্দ্র যত
চন্দ্র
জিনি বিহরে ॥
শ্যামগুণধাম
পশি, হাম
হদিমন্দিরে,
প্রাণ
মন জ্ঞান সখি
হরে নিল
বাঁশির স্বরে,
গঙ্গানারায়ণের
যে দুঃখ
সে-কথা বলিব
কারে,
জানতে
যদি যেতে গো
সখী যমুনায় জল
আনিবারে ॥
(৩)
—
শ্যামাপদ-আকাশেতে
মন ঘুড়িখান
উড়তেছিল;
কলুষের
কুবাতাস পেয়ে
গোপ্তা খেয়ে
পড়ে গেল।
[ঈশ্বরলাভের উপায় অনুরাগ — গোপীপ্রেম — “অনুরাগ বাঘ” ]
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — বাঘ যেমন কপকপ করে জানোয়ার খেয়ে ফেলে, তেমনি “অনুরাগ বাঘ” কাম ক্রোধ এই সব রিপুদের খেয়ে ফেলে। ঈশ্বরে একবার অনুরাগ হলে কামক্রোধাদি থাকে না। গোপীদের ওই অবস্থা হয়েছিল। কৃষ্ণে অনুরাগ।
“আবার আছে ‘অনুরাগ অঞ্জন’। শ্রীমতী বলছেন, ‘সখি, চতুর্দিক কৃষ্ণময় দেখছি!’ তারা বললে, ‘সখি, অনুরাগ-অঞ্জন চোখে দিয়েছ তাই ওইরূপ দেখছ।’ এরূপ আছে যে, ব্যাঙের মুণ্ডু পুড়িয়ে কাজল তৈয়ার করে, সেই কাজল চোখে দিলে চারিদিক সর্পময় দেখে!
“যারা কেবল কামিনী-কাঞ্চন নিয়ে আছে — ঈশ্বরকে একবারও ভাবে না, তারা বদ্ধজীব। তাদের নিয়ে কি মহৎ কাজ হবে? যেমন কাকে ঠোকরানো আম, ঠাকুর সেবায় লাগে না, নিজের খেতেও সন্দেহ।
“বদ্ধজীব — সংসারী জীব, এরা যেমন গুটিপোকা। মনে করলে কেটে বেরিয়ে আসতে পারে; কিন্তু নিজে ঘর বানিয়েছে, ছেড়ে আসতে মায়া হয়। শেষে মৃত্যু।
“যারা মুক্তজীব, তারা কামিনী-কাঞ্চনের বশ নয়। কোন কোন গুটিপোকা অত যত্নের গুটি কেটে বেরিয়ে আসে। সে কিন্তু দু-একটা।
“মায়াতে ভুলিয়ে রাখে। দু-একজনের জ্ঞান হয়; তারা মায়ার ভেলকিতে ভোলে না; কামিনী-কাঞ্চনের বশ হয় না। আঁতুড়ঘরের ধূলহাঁড়ির খোলা যে পায়ে পরে, তার বাজিকরের ড্যাম্ ড্যাম্ শব্দের ভেলকি লাগে না। বাজিকর কি করছে সে ঠিক দেখতে পায়।
“সাধনসিদ্ধ আর কৃপাসিদ্ধ। কেউ কেউ অনেক কষ্টে ক্ষেত্রে জল ছেঁচে আনে; আনতে পারলে ফসল হয়। কারু জল ছেঁচতে হল না, বৃষ্টির জলর ভেসে গেল। কষ্ট করে জল আনতে হল না। এই মায়ার হাত থেকে এড়াতে গেলে কষ্ট করে সাধন করতে হয়। কৃপাসিদ্ধের কষ্ট করতে হয় না। সে কিন্তু দু-এক জনা।
“আর নিত্যসিদ্ধ, এদের জন্মে জন্মে জ্ঞানচৈতন্য হয়ে আছে। যেমন ফোয়ারা বুজে আছে। মিস্ত্রী এটা খুলতে ফোয়ারাটাও খুলে দিলে, আর ফরফর করে জল বেরুতে লাগল! নিত্যসিদ্ধের প্রথম অনুরাগ যখন লোকে দেখে, তখন অবাক্ হয়। বলে এত ভক্তি-বৈরাগ্য-প্রেম কোথায় ছিল?”
ঠাকুর অনুরাগের কথা বলিতেছেন। গোপীদের অনুরাগের কথা। আবার গান হইতে লাগিল। রামলাল গাহিতেছেন:
নাথ!
তিমি সর্বস্ব
আমার।
প্রাণাধার
সারাৎসার;
নাহি
তোমা বিনে কেহ
ত্রিভুবনে,
বলিবার আপনার ॥
তুমি
সুখ শান্তি,
সহায় সম্বল,
সম্পদ
ঐশ্বর্য,
জ্ঞান বুদ্ধি
বল,
তুমি বাসগৃহ,
আরামের স্থল,
আত্মীয় বন্ধু
পরিবার ॥
তুমি ইহকাল, তুমি
পরিত্রাণ,
তুমি পরকাল,
তুমি স্বর্গধাম,
তুমি
শাস্ত্রবিধি
গুরুকল্পতরু,
অনন্ত সুখের
আধার ॥
তুমি
হে উপায়, তুমি
হে উদ্দেশ্য,
তুমি স্রষ্টা
পাতা তুমি হে উপাস্য,
দণ্ডদাতা পিতা,
স্নেহময়ী
মাতা,
ভবার্ণবে কর্ণধার
(তুমি) ॥
শ্রীরামকৃষ্ণ (ভক্তদের প্রতি) — আহা কি গান! “তুমি সর্বস্ব আমার!” গোপীরা অক্রুর আসবার পর শ্রীমতীকে বললে, রাধে! তোর সর্বস্ব ধন হরে নিতে এসেছে! এই ভালবাসা। ভগবানের জন্য এই ব্যাকুলতা।
আবার গান চলিতে লাগিল:
(১)
—
ধোরো
না ধোরো না
রথচক্র রথ কি
চক্রে চলে,
যে চক্রের
চক্রের চক্রী
হরি যার চক্রে
জগৎ চলে।
(২) — প্যারী! কার তরে আর, গাঁথ হার যতনে।
গান শুনিতে শুনিতে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গভীর সমাধিসিন্ধুমধ্যে মগ্ন হইলেন! ভক্তেরা একদৃষ্টে ঠাকুরের দিকে অবাক্ হইয়া দেখিতেছেন। আর সাড়াশব্দ নাই। ঠাকুর সমাধিস্থ! হাতজোড় করিয়া বসিয়া আছেন, যেমন ফটোগ্রাফে দেখা যায়। কেবল চক্ষের বাহিরের কোণ দিয়া আনন্দধারা পড়িতেছে।
[ঈশ্বরের সহিত কথা — শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন — কৃষ্ণ সর্বময় ]
অনেকক্ষণ পরে ঠাকুর একটু প্রকৃতস্থ হইলেন। কিন্তু সমাধির মধ্যে যাঁকে দর্শন করিতেছিলেন, তাঁর সঙ্গে কি কথা কহিতেছেন। একটি-আধটি কেবল ভক্তদের কানে পৌঁছিতেছে। ঠাকুর আপনা-আপনি বলিতেছেন, “তুমিই আমি আমিই তুমি। তুমি খাও, তুমি আমি খাও!... বেশ কিন্তু কচ্ছ।
“এ কি ন্যাবা লেগেছে। চারিদিকেই তোমাকে দেখছি!
“কৃষ্ণ হে দীনবন্ধু প্রাণবল্লভ! গোবিন্দ!”
প্রাণবল্লভ! গোবিন্দ! বলিতে বলিতে আবার সমাধিস্থ হইলেন। ঘর নিস্তব্ধ। ভক্তগণ মহাভাবময় ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে — অতৃপ্ত-নয়নে বারবার দেখিতেছেন।