১৩ ভক্তসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
১৮৮৩, ১৫ই এপ্রিল
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ও সাকার-নিরাকার
রাত্রি প্রায় সাড়ে নয়টা। শ্রীশ্রীঅন্নপূর্ণা ঠাকুরদালান আলো করিয়া আছেন। সম্মুখে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তসঙ্গে দাঁড়াইয়া। সুরেন্দ্র, রাখাল, কেদার, মাস্টার, রাম, মনোমোহন ও অন্যান্য অনেক ভক্তেরা রহিয়াছেন। তাঁহারা সকলে ঠাকুরের সঙ্গে প্রসাদ পাইয়াছেন। সুরেন্দ্র সকলকে পরিতোষ করিয়া খাওয়াইয়াছেন। এইবার ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর-বাগানে প্রত্যাবর্তন করিবেন। ভক্তেরাও স্ব স্ব ধামে চলিয়া যাইবেন। সকলেই ঠাকুরদালানে আসিয়া সমবেত হইয়াছেন।
সুরেন্দ্র (শ্রীরামকৃষ্ণের প্রতি) — আজ কিন্তু মায়ের নাম একটিও হল না।
শ্রীরামকৃষ্ণ (ঠাকুরের প্রতিমা দেখাইয়া) — আহা, কেমন দালানের শোভা হয়েছে। মা যেন আলো করে বসে আছেন। এরূপ দর্শন কল্লে কত আনন্দ হয়। ভোগের ইচ্ছা, শোক — এ-সব পালিয়ে যায়। তবে নিরাকার কি দর্শন হয় না — তা নয়। বিষয়বুদ্ধি একটুও থাকলে হবে না; ঋষিরা সর্বত্যাগ করে অখণ্ড সচ্চিদানন্দের চিন্তা করেছিলেন।
“ইদানীং ব্রহ্মজ্ঞানীরা ‘অচল ঘন’ বলে গান গায়, — আমার আলুনী লাগে। যারা গান গায়, যেন মিষ্টরস পায় না। চিটেগুড়ের পানা দিয়ে ভুলে থাকলে, মিছরীর পানার সন্ধান কত্তে ইচ্ছা হয় না।
“তোমরা দেখ, কেমন বাহিরে দর্শন কচ্ছ আর আনন্দ পাচ্ছ। যারা নিরাকার নিরাকার করে কিছু পায় না, তাদের না আছে বাহিরে না আছে ভিতরে।”
ঠাকুর মার নাম করিয়া গান গাহিতেছেন:
গো
আনন্দময়ী হয়ে
আমায়
নিরানন্দ কর
না।
ও দুটি চরণ বিনা
আমার মন, অন্য
কিছু আর জানে
না ॥
তপন-তনয়,
আমায় মন্দ কয়,
কি দোষে তাতো
জানি না।
ভবানী
বলিয়ে, ভবে
যাব চলে, মনে
ছিল এই বাসনা,
অকূলপাথরে
ডুবাবে আমারে,
স্বপনেও তা
জানি না ॥
অহরহর্নিশি
শ্রীদুর্গানামে
ভাসি, তবু
দুখরাশি গেল
না।
এবার
যদি মরি, ও
হরসুন্দরী,
(তোর) দুর্গানাম
কেউ আর লবে না ॥
আবার গাহিতেছেন:
বল রে বল
শ্রীদুর্গানাম।
(ওরে আমার
আমার মন রে) ॥
দুর্গা
দুর্গা
দুর্গা বলে পথ
চলে যায়।
শূলহস্তে
শূলপাণি
রক্ষা করেন
তায় ॥
তুমি
দিবা, তুমি
সন্ধ্যা, তুমি
সে যামিনী।
কখন
পুরূষ হও মা,
কখন কামিনী ॥
তুমি
বল ছাড় ছাড়
আমি না ছাড়িব।
বাজন
নূপুর হয়ে মা
চরণে বাজিব ॥
(জয় দুর্গা
শ্রীদুর্গা
বলে)।
শঙ্করী
হইয়ে মাগো
গগনে উড়িবে।
মীন
হয়ে রব জলে
নখে তুলে লবে ॥
নখাঘাতে
ব্রহ্মময়ী
যখন যাবে মোর
পরাণী,
কৃপা
করে দিও রাঙা
চরণ দুখানি।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আবার প্রতিমার সম্মুখে প্রণাম করিলেন। এইবার সিঁড়িতে নামিবার সময় ডাকিয়া বলিতেছেন, “ও রা-জু-আ”? (ও রাখাল, জুতো সব আছে, না হারিয়ে গেছে?)
ঠাকুর গাড়িতে উঠিলেন। সুরেন্দ্র প্রণাম করিলেন। অন্যান্য ভক্তেরাও প্রণাম করিলেন। রাস্তায় চাঁদের আলো এখনও আছে। ঠাকুরের গাড়ি দক্ষিণেশ্বর অভিমুখে যাত্রা করিল।