১৭ শ্রীরামকৃষ্ণের সিঁদুরিয়াপটী ব্রাহ্মসমাজে, কমলকুটিরে ও
শ্রীযুক্ত জয়গোপাল সেনের বাড়িতে আগমন

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

১৮৮৩, ২৮শে নভেম্বর


শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ — ঈশ্বরাবেশে মার সঙ্গে কথা

ঠাকুর অনেকক্ষণ বসিয়া আছেন। কেশবকে দেখিবার জন্য অধৈর্য হইয়াছেন। কেশবের শিষ্যেরা বিনীতভাবে বলিতেছেন, তিনি একটু এই বিশ্রাম করছেন, এইবার একটু পরে আসছেন।

কেশবের সঙ্কটাপন্ন পীড়া। তাই শিষ্যেরা ও বাড়ির লোকেরা এত সাবধান। ঠাকুর কিন্তু কেশবকে দেখিতে উত্তরোত্তর ব্যস্ত হইতেছেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ (কেশবের শিষ্যদের প্রতি) — হ্যাঁগা! তাঁর আসবার কি দরকার? আমিই ভেতরে যাই না কেন?

প্রসন্ন (বিনীতভাবে) — আজ্ঞে, আর একটু পরে তিনি আসছেন।

ঠাকুর — যাও; তোমরাই অমন করছ! আমিই ভিতরে যাই।

প্রসন্ন ঠাকুরকে ভুলাইয়া কেশবের গল্প করিতেছেন।

প্রসন্ন — তাঁর অবস্থা আর-একরকম হয়ে গেছে। আপনারই মতো মার সঙ্গে কথা কন। মা কি বলেন, শুনে হাসেন-কাঁদেন।

কেশব জগতের মার সঙ্গে কথা কন, হাসেন-কাঁদেন — এই কথা শুনিবামাত্র ঠাকুর ভাবাবিষ্ট হইতেছেন। দেখিতে দেখিতে সমাধিস্থ!

ঠাকুর সমাধিস্থ! শীতকাল, গায়ে সবুজ রঙের বনাতের গরম জামা; জামার উপর একখানি বনাত। উন্নত দেহ, দৃষ্টি স্থির। একেবারে মগ্ন! অনেকক্ষণ এই অবস্থায়। সমাধিভঙ্গ আর হইতেছে না।

সন্ধ্যা হইয়াছে! ঠাকুর একটু প্রকৃতিস্থ। পার্শ্বের বৈঠকখানায় আলো জ্বালা হইয়াছে। ঠাকুরকে সেই ঘরে বসাইবার চেষ্টা হইতেছে।

অনেক কষ্টে তাঁহাকে বৈঠকখানার ঘরে লইয়া যাওয়া হইল।

ঘরে অনেকগুলি আসবাব — কৌচ, কেদারা, আলনা, গ্যাসের আলো। ঠাকুরকে একখানা কৌচের উপর বসানো হইল।

কৌচের উপর বসিয়াই আবার বাহ্যশূন্য, ভাবাবিষ্ট।

কৌচের উপর দৃষ্টিপাত করিয়া যেন নেশার ঘোরে কি বলিতেছেন, “আগে এ-সব দরকার ছিল। এখন আর কি দরকার?

(রাখাল দৃষ্টে) — “রাখাল, তুই এসেছিস?”

[জগন্মাতাদর্শন ও তাঁহার সহিত কথা — Immortality of the Soul]

বলিতে বলিতে ঠাকুর আবার কি দেখিতেছেন। বলছেন,

“এই যে মা এসেছো! আবার বারাণসী কাপড় পরে কি দেখাও। মা হ্যাঙ্গাম করো না! বসো গো বসো!”

ঠাকুরের মহাভাবের নেশা চলিতেছে। ঘর আলোকময়। ব্রাহ্মভক্তেরা চর্তুদিকে আছেন। লাটু, রাখাল, মাস্টার ইত্যাদি কাছে বসিয়া আছেন। ঠাকুর ভাবাবস্থায় আপনা-আপনি বলিতেছেন,

“দেহ আর আত্মা। দেহ হয়েছে আবার যাবে! আত্মার মৃত্যু নাই। যেমন সুপারি; পাকা সুপারি ছাল থেকে আলাদা হয়ে থাকে, কাঁচা বেলায় ফল আলাদা আর ছাল আলাদা করা বড় শক্ত। তাঁকে দর্শন করলে, তাঁকে লাভ করলে দেহবুদ্ধি যায়! তখন দেহ আলাদা, আত্মা আলাদা বোধ হয়।”

[কেশবের প্রবেশ]

কেশব ঘরে প্রবেশ করিতেছেন। পূর্বদিকে দ্বার দিয়া আসিতেছেন। যাঁহারা তাঁহাকে ব্রাহ্মসমাজ-মন্দিরে বা টাউনহলে দেখিয়াছিলেন, তাঁহারা তাঁহার অস্থিচর্মসার মূর্তি দেখিয়া অবাক্‌ হইয়া রহিলেন। কেশব দাঁড়াইতে পারিতেছেন না, দেয়াল ধরিয়া ধরিয়া অগ্রসর হইতেছেন। অনেক কষ্টের পর কৌচের সম্মুখে আসিয়া বসিলেন।

ঠাকুর ইতিমধ্যে কৌচ হইতে নামিয়া নিচে বসিয়াছেন। কেশব ঠাকুরকে দর্শনলাভ করিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া অনেকক্ষণ ধরিয়া প্রণাম করিতেছেন। প্রণামান্তর উঠিয়া বসিলেন। ঠাকুর এখনও ভাবাবস্থায়। আপনা-আপনি কি বলিতেছেন। ঠাকুর মার সঙ্গে কথা কহিতেছেন।