ঈশা-অনুসরণ
[স্বামীজী আমেরিকা যাইবার বহুপূর্বে বাঙলা ১২৯৬ সালে, অধুনালুপ্ত ‘সাহিত্য- কল্পদ্রুম’ নামক মাসিক পত্রে ‘Imitation of Christ’ নামক জগদ্বিখ্যাত পুস্তকের ‘ঈশা-অনুসরণ’ নাম দিয়া অনুবাদ করিতে আরম্ভ করেন। উক্ত পত্রের ১ম বর্ষের ১ম হইতে ৫ম সংখ্যা অবধি অনুবাদের ৬ষ্ঠ পরিচ্ছেদটি পর্যন্ত প্রকাশিত হইয়াছিল। আমরা সমুদয় (প্রকাশিত) অনুবাদটিই এই গ্রন্থে সন্নিবেশিত করিলাম। সূচনাটি স্বামীজীর মৌলিক রচনা।]
সূচনা
‘খ্রীষ্টের অনুসরণ’ নামক এই পুস্তক সমগ্র খ্রীষ্টজগতের অতি আদরের ধন। এই মহাপুস্তক কোন ‘রোম্যান ক্যাথলিক’ সন্ন্যাসীর লিখিত — লিখিত বলিলে ভুল হয়, ইহার প্রত্যেক অক্ষর উক্ত ঈশা-প্রেমে সর্বত্যাগী মহাত্মার হৃদয়ের শোণিতবিন্দুতে মুদ্রিত। যে মহাপুরুষের জ্বলন্ত জীবন্ত বাণী আজি চারি শত বৎসর কোটি কোটি নরনারীর হৃদয় অদ্ভুত মোহিনীশক্তিবলে আকৃষ্ট করিয়া রাখিয়াছে, রাখিতেছে এবং রাখিবে, যিনি আজি প্রতিভা ও সাধনবলে কত শত সম্রাটেরও নমস্য হইয়াছেন, যাঁহার অলৌকিক পবিত্রতার নিকটে পরস্পরে সতত যুধ্যমান অসংখ্য সম্প্রদায়ে বিভক্ত খ্রীষ্ট-সমাজ চিরপুষ্ট বৈষম্য পরিত্যাগ করিয়া মস্তক অবনত করিয়া রহিয়াছে — তিনি এ পুস্তকে আপনার নাম দেন নাই। দিবেন বা কেন? যিনি সমস্ত পার্থিব ভোগ এবং বিলাসকে, ইহজগতের সমুদয় মান-সম্ভ্রমকে বিষ্ঠার ন্যায় ত্যাগ করিয়াছিলেন — তিনি কি সামান্য নামের ভিখারী হইতে পারেন? পরবর্তী লোকেরা অনুমান করিয়া ‘টমাস আ কেম্পিস্’ নামক একজন ক্যাথলিক সন্ন্যাসীকে গ্রন্থকার স্থির করিয়াছেন, কতদূর সত্য ঈশ্বর জানেন। যিনিই হউন, তিনি যে জগতের পূজ্য তাহাতে আর সন্দেহ নাই।
এখন আমরা খ্রীষ্টিয়ান রাজার প্রজা। রাজ-অনুগ্রহে বহুবিধ-নামধারী স্বদেশী বিদেশী খ্রীষ্টিয়ান দেখিলাম। দেখিতেছি, যে মিশনরী মহাপুরুষেরা ‘অদ্য যাহা আছে খাও, কল্যকার জন্য ভাবিও না’ প্রচার করিয়া আসিয়াই আগামী দশ বৎসরের হিসাব এবং সঞ্চয়ে ব্যস্ত — দেখিতেছি, ‘যাঁহার মাথা রাখিবার স্থান নাই’ তাঁহার শিষ্যেরা — তাঁহার প্রচারকেরা বিলাসে মণ্ডিত হইয়া, বিবাহের বরটি সাজিয়া, এক পয়সার মা-বাপ হইয়া ঈশার জ্বলন্ত ত্যাগ, অদ্ভুত নিঃস্বার্থতা প্রচার করিতে ব্যস্ত, কিন্তু প্রকৃত খ্রীষ্টিয়ান দেখিতেছি না। এ অদ্ভুত বিলাসী, অতি দাম্ভিক, মহা অত্যাচারী, বেরুস এবং ব্রুমে চড়া, প্রোটেষ্ট্যাণ্ট খ্রীষ্টিয়ান সম্প্রদায় দেখিয়া খ্রীষ্টিয়ান সম্বন্ধে আমাদের যে অতি কুৎসিত ধারণা হইয়াছে, এই পুস্তক পাঠ করিলে তাহা সম্যক্রূপে দূরীভূত হইবে।
‘সব্ সেয়ানকী এক মত’ — সকল যথার্থ জ্ঞানীরই একপ্রকার মত। পাঠক এই পুস্তক পড়িতে পড়িতে গীতায় ভগবদুক্ত ‘সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ’ উপদেশের শত শত প্রতিধ্বনি দেখিতে পাইবেন। দীনতা, আর্তি এবং দাস্যভক্তির পরাকাষ্ঠা এই গ্রন্থের ছত্রে ছত্রে মুদ্রিত এবং পাঠ করিতে করিতে জ্বলন্ত বৈরাগ্য, অত্যদ্ভুত আত্মসমর্পণ এবং নির্ভরের ভাবে হৃদয় উদ্বেলিত হইবে। যাঁহারা অন্ধ গোঁড়ামির বশবর্তী হইয়া খ্রীষ্টিয়ানের লেখা বলিয়া এ পুস্তককে অশ্রদ্ধা করিতে চাহেন, তাঁহাদিগকে ন্যায়দর্শনের একটি সূত্র বলিয়া ক্ষান্ত হইবঃ ‘আপ্তোপদেশঃ শব্দঃ’ — সিদ্ধপুরুষদিগের উপদেশ প্রামাণ্য এবং তাহারই নাম শব্দপ্রমাণ। এস্থলে ভাষ্যকর ঋষি বাৎস্যায়ন১ বলিতেছেন যে, এই আপ্ত পুরুষ আর্য এবং ম্লেচ্ছ উভয়ত্রই সম্ভব।
যদি ‘যবনাচার্য’ প্রভৃতি গ্রীক জ্যোতিষী পণ্ডিতগণ পুরাকালে আর্যদিগের নিকট এতাদৃশ প্রতিষ্ঠালাভ করিয়া গিয়া থাকেন, তাহা হইলে এই ভক্তসিংহের পুস্তক যে এদেশে আদর পাইবে না, তাহা বিশ্বাস হয় না।
যাহা হউক, এই পুস্তকের বঙ্গানুবাদ আমরা পাঠকগণের সমক্ষে ক্রমে ক্রমে উপস্থিত করিব। আশা করি, রাশি রাশি অসার নভেল-নাটকে বঙ্গের সাধারণ পাঠক যে সময় নিয়োজিত করেন, তাহার শতাংশের একাংশ ইহাতে প্রয়োগ করিবেন।
অনুবাদ যতদূর সম্ভব অবিকল করিবার চেষ্টা করিয়াছি — কতদূর কৃতকার্য হইয়াছি, বলিতে পারি না। যে-সকল বাক্য ‘বাইবেল’-সংক্রান্ত কোন বিষয়ের উল্লেখ করে, নিম্নে তাহার টীকা প্রদত্ত হইবে। কিমধিকমিতি!
১ আপ্তঃখলু সাক্ষাৎকৃতধর্মা যথাদৃষ্টস্য ঋষ্যার্যম্লেচ্ছানাং সমানাং লক্ষণম্। বাৎস্যায়ন ভাষ্য। [১।১।৭]